বেসরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে বৈষম্য শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডেই সীমাবদ্ধ নয়

বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি নিয়ে লিখলেও বাস্তবে সরকার এ ব্যাপারে সচেষ্ট নয়। কোনো আইন না থাকায় বেশির ভাগ কোম্পানি সুবিধা দেয় না। এদিকে সরকারও বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর বিভিন্নভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আরও চাপ প্রয়োগ করছে। হ্যাঁ! আমরা সবাই বুঝি, দেশে সরকার আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে নেই।

কিন্তু তার সব চাপ কেন বেসরকারি খাতের মানুষদের নিতে হবে? এই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি (যার প্রধান কারণ সরকারি ভুল নীতি), তার ভুক্তভোগী কেন শুধু বেসরকারি খাতের মানুষেরা হবে? কিন্তু এই দ্বৈতনীতি দেশের মানুষদের মধ্যে একটা অদৃশ্য সামাজিক দেয়াল তৈরি করে দিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

প্রথমেই বলে নিই, এ লেখার উদ্দেশ্য সরকারি কর্মজীবীদের কোনো সুযোগ কমানো নয়। কেউ কোনো সুযোগ-সুবিধা পেলে তা কমানো উচিতও নয়, আর কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট বা চুক্তি আইনে এ–সংক্রান্ত বাধাও আছে। কিন্তু দেশে বিভিন্ন হিসাব–নিকাশের কারণে বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ যাতে বিভাজনের শিকার না হয়, সেটাই এ লেখার উদ্দেশ্য। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঞ্চিত করে দেশ উন্নত হতে পারে না।

এখন দেখি কোন কোন খাতে সরকারি দ্বৈতনীতি বেসরকারি কর্মজীবীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা

সরকারি খাতে কর্মজীবীদের জন্য চমৎকার আইন আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে আছে ১৮৭২ সালের ‘কন্ট্রাক্ট আইন’ আর ‘লেবার ল’, যেখানে মালিকদের জন্য রয়েছে বিশেষ ছাড়। চুক্তিতে যা খুশি লিখে সই করেও নিতে পারে তারা, আবার শ্রম আইনে আছে অনেক কিছু ঐচ্ছিক। এ কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি কর্মজীবী অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এভাবে আর কত দিন? সবার মতো বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য আইন আসতে হবে, যেখানে অবশ্যই প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি, বিমা, মুনাফা শেয়ার—এগুলো বাধ্যতামূলক থাকতে হবে।

প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির আয়ের ওপর কর

আগে থেকেই বেসরকারি খাতের কর্মীদের অবসরকালীন সুবিধা তহবিলের আয়ের ওপর কর দিতে হতো, যা ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালের আগেও এটি ছিল করমুক্ত। এখন বেড়ে হয়েছে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর, যা বিনিয়োগের মুনাফার ওপর প্রযোজ্য। যেখানে সরকার সামাজিক নিরাপত্তায় কোনো সুবিধাই দিতে পারছে না, সেখানে আরও নিরুৎসাহিত করা পুরোটাই অনৈতিক। সরকারের উচিত ছিল প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি সব কোম্পানিকে বাধ্যতামূলক করে, সব কর উঠিয়ে দিয়ে মানুষের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা। সরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে সরকার নিজেই সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অবিলম্বে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর বাতিল করে বেসরকারি কর্মজীবীরাও যাতে ১৩ শতাংশ করে সুদ পায়, সেই ব্যবস্থা করে সমতায়ন করা উচিত।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম

এ স্কিম আসলে সফল হতো, যদি এটা সর্বজনীন হতো। কিন্তু এখানেও সরকারি–বেসরকারি আলাদা। সরকারি কর্মজীবীদের পেনশন দেওয়া হবে বেসরকারি খাতের মানুষের কর দিয়ে। আবার বেসরকারি খাতের মানুষেরা পেনশন পাবে, এখানেও নিজের টাকা দিয়ে। এই দ্বৈতনীতি অবিলম্বে বাতিল করে হয় সরকারি খাতকেও পেনশন স্কিমে আনতে হবে (যা তার ৭.৪ শতাংশ খরচ কমিয়ে দেবে), অথবা বেসরকারি খাতের মানুষদেরও তাদের দেওয়া কর অনুপাতে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

আয়কর

সরকারি কর্মজীবীদের কর দিতে হয় তাদের মূল বেতন (বেসিক) আর বোনাসের ওপর শুধু। এদিকে বেসরকারি কর্মজীবীদের বেতনের সব ভাতার ওপর, যা আর একটি দ্বৈত আইন। ফলে তারা পরিমাণে কম টাকা পায়। কিন্তু এই কর দেওয়ার ফলে কোনো আলাদা সুবিধাই পাচ্ছে না। এদিকে যারা বড় ব্যবসায়ী আছে দেশে, তারা কি ঠিকমতো কর দিচ্ছে?

বেতনকাঠামো আধুনিকায়ন

সরকারি কর্মজীবীদের একটা বড় কথা আছে—তাদের বেতন কম। সমস্যা হচ্ছে, তাদের বেতনকাঠামো সেই ব্রিটিশ আমলে যেভাবে চলে আসছে (যা এখন যুক্তরাষ্ট্র কেন আমাদের পাশের দেশ ভারতও বাতিল করে দিয়েছে), সেভাবেই চলছে। তাদের বেতন বললেই বলে শুধু মূল বেতন। এর সঙ্গে যে অনেক ভাতাসহ আরও সুযোগ-সুবিধা আছে, তা মানতেই চায় না। শুধু বেসরকারি খাতে কেন, সারা পৃথিবীতে চলছে আধুনিক সিটিসি (কস্ট টু কোম্পানি) পদ্ধতি।

যেখানে মূল বেতনের সঙ্গে সব ভাতা, বোনাস, ট্যাক্স, রিয়ারমেন্ট বেনিফিটসহ আরও কোনো সুবিধা পেলে যে খরচ হয় (যেমন গাড়ি, ইনস্যুরেন্স, চিকিৎসা ইত্যাদি) সব বার্ষিকভাবে হিসাব করে মাসের মধ্যে ভাগ করে ফেলা যায়। ফলে বেতন অনেক বেশি দেখায়। সরকারি কর্মজীবীদেরও যদি কাঠামো আধুনিকায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মাত্র ২ শতাংশ বেসরকারি কর্মজীবী সমসাময়িক সরকারিদের থেকে বেশি পায়। এই আধুনিকায়ন না হওয়ায় মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা চলে আসছে। আর এর সুযোগ নেওয়া হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, মাত্র ১৪ লাখ মানুষের পেছনে সরকার তার বাজেটের ২২ দশমিক ২ শতাংশ খরচ করছে, সিটিসি কনসেপ্টে গেলে তা আরও বাড়ত, আর বাস্তব সংখ্যা আমরা পেতে পারতাম।

কৃচ্ছ্রসাধন দ্বৈতনীতি

সরকার বর্তমান অবস্থায় সবাইকে খরচ কমাতে বললেও নিজে বিভিন্ন প্রজেক্টে অতিরিক্ত গাড়ি, অস্ত্র, বিমান ইত্যাদি কিনেই যাচ্ছে। বিদেশে অপ্রয়োজনীয় ট্যুর, অতিরিক্ত প্রমোশন এবং অতিরিক্ত সফরসঙ্গী নিয়ে যাওয়াও আছে। কিন্তু সব দায় পড়েছে বেসরকারি খাতের ওপর। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ডলার–সংকটে এলসি করতে পারছে না। তাদের এই না পারা চাপ প্রয়োগ করছে তাদের কর্মীদের ওপর। ছাঁটাই, ইনক্রিমেন্ট বন্ধসহ অনেকভাবে তারা খরচ কমাচ্ছে। সরকার কি এখানেও দ্বৈতনীতি নিচ্ছে না?

সরকার এখন টাকার সংকটে আছে। আর এ জন্য করের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আয়কর কর্মকর্তারা আয়করসীমা বাড়াতে না পেরে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য যারা কর দিচ্ছে, তাদের ওপরই আরও খড়্গহস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমলারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধায় যাতে কোনো হাত না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রেখে একের পর এক আইন করে যাচ্ছে।

এই আমলারাই সামনে নির্বাচনের সুযোগে সরকার থেকে বাড়তি সুবিধাও নিচ্ছে। এখনই শুধু পেনশন আর বেতন–ভাতা দিয়ে সরকারি কর্মজীবীদের পেছনে সরকারের খরচ যায় ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যা বাজেটের সবচেয়ে বেশি খরচের খাত। এটি বহন করতে হচ্ছে বেসরকারি খাতকেই। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণখেলাপি কমানোর চেষ্টা না করে খেলাপিদের সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না, যাচ্ছে না টাকা পাচার ঠেকানোরও চেষ্টা। আর তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য ‘বলির পাঁঠা’ হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

সরকার কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়। এ সংবিধানেই আছে সম–অধিকারের কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা (যারা আমাদের করের টাকাতে চলে), আর যারা আসল মালিক জনগণ (যাদের টাকায় দেশ চলে) এবং সুবিধাভোগী (যারা জনগণের টাকা পাচার করে), তাদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ জনগণ হয়ে যাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির, যা পুরোপুরি সংবিধানবিরুদ্ধ। এর দায় পুরোপুরি সরকারের। সম–অধিকার চাওয়াটা কি খুব বেশি দাবি হচ্ছে? দেশটা তো আমাদেরই, তাই না?

  • সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
    ই-মেইল: subail001@gmail.com