রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আবার ‘জাতিগত বিভেদের কার্ড’ খেলতে শুরু করেছে। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের অনেকে সেই ফাঁদে পড়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা গোঁড়া, তারা জান্তার খেলায় পুতুলের মতো নাচতে শুরু করেছে।
রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সম্পর্ক গত ছয় বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে। অনেকগুলো ঘটনা ও উদার কর্মকাণ্ড এই সম্পর্ক উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে।
২০১৮-১৯ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা রাখাইনদের খাবার ও পরিবহন দিয়ে সমর্থন দিয়েছিল। কালাদান নদী পার হয়ে রাখাইনদের পালিয়ে যেতে রোহিঙ্গা মাঝিরা সহায়তা করেছিলেন। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে খেলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতার আয়োজক রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায় ও আরাকান আর্মি।
ঘূর্ণিঝড় মোচার পর রোহিঙ্গারা যে যৎসামান্য সহযোগিতা পেয়েছে, তা তারা রাখাইনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। রোহিঙ্গারা সিত্তে শহরে এখন শান্তিপূর্ণভাবে চলাফেরা করতে পারে।
যা–ই হোক, এখনো অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের মধ্যে শিক্ষার ঘাটতি আছে, যাঁরা কোনো কিছুর ভালো-মন্দ চিন্তা করতে পারেন না এবং অন্য সম্প্রদায়কে এখনো পুরোনো কুসংস্কার দিয়ে বিচার করেন।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে যাঁরা রাখাইন রাজ্যের বাইরে কিছুদিন ধরে বাস করছেন অথবা যাঁদের জন্ম অন্য দেশে, তাঁরা এখনো রাখাইনদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ করে চলেছেন।
টুইটারে (এখন এক্স) একজন টুইট করেছেন এই বলে যে ‘আরাকান রোহিঙ্গাদের রাজ্য’। আরেকজন টুইট করেছেন, ‘লড়াই ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিকল্প পথ নাই’। এ টুইটগুলো প্ররোচনামূলক। এই টুইটগুলো পুরোনো ধ্যানধারণার রাখাইনদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই রাখাইনদের মধ্যে এই উদ্বেগ রয়েছে যে রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র চায়।
এখন যখন রাখাইন রাজ্যে জান্তার সেনাবাহিনী ব্যাপক পরাজয়ের মুখে, তখন তারা মরিয়া হয়ে আবারও জাতি কার্ড খেলতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগে, সিত্তে শহরের কাছে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত অঞ্চল অং মিনগালারে ডাকাতি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরাকান আর্মির ঘাড়ে দায় চাপানো হয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে যে এ ঘটনার পেছনে জান্তা সরকারের প্রক্সি বাহিনী আরাকান লিবারেশন আর্মি (এএলএ) দায়ী।
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিবাদটি হয়েছে ২৩ মার্চ সকালে সিত্তে শহরের বুমে রোহিঙ্গা বসতিতে। এবার রোহিঙ্গাদের হুমকি দেওয়া হয় যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে না গেলে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়, যাদের অধিকাংশ ছিল শিশু। সাদাপোশাকের পুলিশ প্রতিবাদ কর্মসূচি তদারক করে। সামরিক জান্তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা সেটা রেকর্ড করে।
এর কয়েক দিন পর, সিত্তেতে অবস্থিত অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) শিবির থেকে ৪০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসা হয়। দেশব্যাপী সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের যে আইন পাস করেছে জান্তা সরকার, তার অংশ হিসেবে ক্যাম্প থেকে তাঁদের নিয়ে আসা হয়। দুই সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণের পর তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। এ কাজের পেছনে জান্তা সরকারের উদ্দেশ্য হলো, আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে এই রোহিঙ্গারা যেন নিহত হন।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক গণহত্যার পর এটা খুব করে পরিষ্কার, রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে মোটেই ইচ্ছুক নন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের ভিডিও দেখে রাখাইনদের কেউ কেউ ভাবছেন, রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। অনেকে রোহিঙ্গাদের বিদ্রূপ করছেন ও হুমকি দিচ্ছেন। এর ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকে সিত্তে শহরের বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
১৯ মার্চ বুথিডাং শহরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদ করতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে সেই প্রতিবাদে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। একই দিন মংডুর কাছাকাছি কেয়িন তান গ্রাম থেকে ৫০ জন রোহিঙ্গাকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে যায় জান্তা সেনারা।
বেশির ভাগ রাখাইন বোকার মতো এই বিশ্বাস করতে রাজি নন যে যে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যা চালিয়েছে, তাঁরা জান্তার পক্ষ হয়ে লড়াই করবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে রাখাইনদের কেউ কেউ সেটা বিশ্বাসও করছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বুথিডাং শহরের ওই প্রতিবাদের পর একজন রাখাইন নারী টিকটক ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রূপ করে ‘কালা’ (খুবই অসম্মানসূচক শব্দ) বলেছেন ও হুমকি দিয়েছেন। একজন বর্ণবাদী ধর্মগুরু মিথ্যা প্রচার চালিয়ে বলেছেন, ৩০০ জন মুসলমান মসজিদ থেকে ‘জিহাদ’ চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এসেছেন।
এ খবর পাওয়া গেছে যে বুথিডাং শহরে কিছু আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বিষয়টি জান্তা সরকার জানে। এই জল্পনা আছে যে জান্তা সরকার আরসাকে সহযোগিতা করছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আরসা যখন প্রথম দৃশ্যপটে হাজির হয়, তখন থেকেই গুজব আছে যে আরসার সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগসূত্র আছে।
রোহিঙ্গাদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে জানা যাচ্ছে, বুথিডাং শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ মার্চ আগুন লাগে। এতে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছেন। গুজব ছড়িয়েছে, রোহিঙ্গা চরমপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে আরাকান আর্মি আগুন দিয়েছে।
আগুনের উৎস সম্পর্কে এই লেখক নিশ্চিত নন। জান্তা সরকার কীভাবে গুজব ছড়াতে ও জাতিগত সংঘাত উসকাতে ব্যবহার করছে, আগুনের এই ঘটনা তার দৃষ্টান্ত।
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিবাদটি হয়েছে ২৩ মার্চ সকালে সিত্তে শহরের বুমে রোহিঙ্গা বসতিতে। এবার রোহিঙ্গাদের হুমকি দেওয়া হয় যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে না গেলে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়, যাদের অধিকাংশ ছিল শিশু। সাদাপোশাকের পুলিশ প্রতিবাদ কর্মসূচি তদারক করে। সামরিক জান্তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা সেটা রেকর্ড করে।
রাখাইন রাজ্যে বড় বিপর্যয় দেখে জান্তা সরকার যত দ্রুত সম্ভব জাতিগত বিভক্তি তৈরি করতে চাইছে। প্রশ্ন হলো, জান্তার এই খেলায় রাখাইন ও রোহিঙ্গারা কতটা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন। সেটা নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের মিলমিশ কতটা গভীর হয়েছে, তার ওপর।
পল গ্রিনিং, জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা
দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে