ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন নারীরা। রাজস্থান।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন নারীরা। রাজস্থান।

ভারতের নির্বাচন ও বাংলাদেশের বাজেট, যে শিক্ষা আমরা পেলাম

৪ জুন ভারতের জাতীয়, তথা লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোল। ৬ জুন বাংলাদেশে নতুন সরকার প্রথম বাজেট দিল।

দুটি স্বাধীন দেশের দুই ঘটনা তুলনীয় নয়; কিন্তু দুটি দেশই যেহেতু গণতান্ত্রিক, দুটি দেশেই যেহেতু গণতন্ত্রের চর্চা ক্ষয়িষ্ণু, সেহেতু নির্বাচনের ‘ইস্যু’ এবং বাজেটের অগ্রাধিকারের মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করা যায়।

মোটাদাগে বলা যায়, ভারতে জনগণের সমস্যাকে দূরে রেখে বড় ব্যবসায়ীদের তোষণের নীতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নির্বাচনে বিপাকে ফেলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও ব্যবসায়ীসহ বিশেষ গোষ্ঠীকে তোষণের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না, সেহেতু জনগণই বঞ্চিত হন। বারবার বাড়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের দাম।

ভারতের নির্বাচন

ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী ইন্ডিয়া জোটকে শুধু হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিই মোকাবিলা করতে হয়নি, তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে বড় ব্যবসায়ীদের বিপুল টাকার, নিজেদের আর্থিক দুরবস্থার, ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট), সিবিআইয়ের (সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) মতো সরকারি সংস্থার, সরকারি দলের প্রতি গণমাধ্যমের তীব্র পক্ষপাতের। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, চোরাস্রোত এড়িয়ে বিরোধীরা হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে বড় দুর্গ (উত্তর প্রদেশে হার) ভেঙে দিয়েছে। তারা নির্বাচনে জিততে পারেনি, সরকারও গঠন করতে পারছে না, কিন্তু তাদের মুখে হাসি।

ভারতের সাড়ে আট দশকের ইতিহাসে এবারের নির্বাচনের পরই সম্ভবত প্রথমবারের মতো দুই প্রধান দলের কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। অবশ্য কংগ্রেসের কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণে উৎসাহ ও তৃপ্তি বেশি ছিল। বিজেপির কার্যালয়ে সেটা দেখা যায়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোটের ফলাফলের পর নিজ দলের কার্যালয়ে গেলেও তাঁর মুখে সেই হাসি ছিল না, যেটা ছিল ২০১৯ সালে।

যাঁরা ভারতের নির্বাচনের ফলাফল জানেন না তাঁদের জানিয়ে রাখি, ৪০০ আসন পাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করে সরকার গঠনের জন্য ২৭২ আসনও বিজেপি পায়নি। তারা থেমেছে ২৪০ আসনে, যা গতবারের চেয়ে ৬৩টি কম। নরেন্দ্র মোদিকে প্রথমবারের মতো জোট সরকার গঠন করতে হচ্ছে নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের সঙ্গে। এই দুই নেতা আবার ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য সুপরিচিত।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিগত দুবারের মতো এবারও বিজেপির মূল হাতিয়ার ছিল হিন্দুত্ববাদ। ভোট শুরুর কয়েক মাস আগে গত জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় নবনির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন করা হয়।

সাত দফার ভোটের মধ্যভাগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎকার ও ভাষণে হিন্দুত্ববাদকে আরও বেশি সামনে নিয়ে আসেন। বিজেপি হয়তো বুঝতে পেরেছিল, ভোটের মাঠে তাদের অবস্থা ততটা ভালো নয়। তাই বলা হলো, বিরোধীরা জিতলে বিবাহিত হিন্দু নারীদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়া হবে, গরু ছিনিয়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি। শেষ দিকে নরেন্দ্র মোদি এ-ও বললেন, তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত।

কংগ্রেস বা বিরোধী অন্য দলগুলো এবার বিজেপির ফাঁদে পা দেয়নি। নিরন্তরভাবে তারা নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্য, ৪৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, কৃষকদের ফসলের দাম না পাওয়া, ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি, গরিব আরও গরিব হওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া, অগ্নিপথ কর্মসূচি বাতিল (সেনাদের চার বছরের জন্য নিয়োগ) এবং সংবিধান রক্ষার কথা বলে গেছে। সংবিধানে ভারতের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।

ভোট শেষে দেখা গেল, কংগ্রেসের আসন দ্বিগুণ হয়েছে, বিজেপির ৬৩টি কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকে যে হারানো যায়, সেই আত্মবিশ্বাস এখন বিরোধীদের চোখেমুখে। এমনকি যে রামমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে বিজেপির একজন প্রার্থী ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধীদের হাতে।

ফল প্রকাশের পরদিন বিজেপির কার্যালয়ে গিয়ে বিজয় ভাষণে নরেন্দ্র মোদি আর ‘জয় শ্রীরাম’ বলেননি, বলেছেন ‘জয় জগন্নাথ’। কারণ, উড়িষ্যায় তাঁর দল ভালো করেছে। উত্তর প্রদেশে ধরাশায়ী হয়েছে।

ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি ফিকে হয়ে গেছে। ভারতের রাজনীতিতে বিরোধীদের জয় এখানেই। কংগ্রেস ভারতের দরিদ্র নারীদের বছরে এক লাখ টাকা নগদ দেওয়ার কথা বলেছে, বেকারদের চাকরি ও ভাতা দেওয়ার কথা বলেছে।

ভারত সরকার এখন ৮০ কোটি মানুষকে বিনা মূল্যে মাসে পাঁচ কেজি করে শস্যদানা সরবরাহ করে। কংগ্রেস সেটা দ্বিগুণ করার কথা বলেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করেছে। আদানিদের মতো ধনীদের ঋণ মওকুফ করার তীব্র বিরোধিতা করেছে।

মানুষের কথা বলে কংগ্রেস ফিরে এসেছে; রাজনীতির ‘পাপ্পু’ (রাহুল গান্ধীকে এই নামে ডেকে কটাক্ষ করে বিজেপি) থেকে নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন রাহুল গান্ধী। ভারতের মানুষ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন এ কারণে যে দেশটি আর ‘তানাশাহি’তে (স্বৈরাচার) পরিণত হওয়ার সুযোগ নেই।

নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদে হয়তো দেখা যাবে আরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যেখানে দরিদ্র নারীদের নগদ টাকা দেওয়া হবে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বাড়ানো হবে, ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রেখে সরকার হয়তো আর বিরোধীদের হাতে ‘ইস্যু’ তুলে দিতে চাইবে না। হয়তো গ্যাস, বিদ্যুৎ, পেট্রল ও পানির দাম বাড়াতে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার দ্বিতীয়বার ভাববে।

এটাই তো গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়, মানুষ ভোট দেয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে বাধ্য করে। কর্তৃত্ববাদী অথবা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারে সেটার প্রয়োজন হয় না। সেখানে জনগণের জন্য ততটুকুই করা হয়, যতটুকু করলে জনরোষ সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। এসব ব্যবস্থায় সরকার ক্ষমতায় থাকে বিশেষ গোষ্ঠীর সহায়তায়; তারাই সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়।

বাংলাদেশের বাজেট

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটটি ৬ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করেন প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হওয়া আবুল হাসান মাহমুদ আলী। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম রিজার্ভ ও মার্কিন ডলারের চড়া দাম, বিদ্যুৎ খাতে বিপুল ভর্তুকির চাহিদা, বাড়তে থাকা সুদের হার, উচ্চ খেলাপি ঋণ, অভ্যন্তরীণ চাহিদা জোরালো না থাকা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে গতিহীনতা, টাকার চরম সংকট—এমন পটভূমির মধ্যেও অর্থমন্ত্রী করপোরেট কর কমিয়েছেন (ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানোর শর্তে)। তা কমানো হয়েছে শেয়ারবাজারে না থাকা কোম্পানির ক্ষেত্রে। মানে হলো, এর সুফল মানুষ মোটেও পাবেন না, পুরোটাই পাবে ব্যবসায়ী পরিবারগুলো।

এই ব্যবসায়ীদের নেতারা গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে একটি সম্মেলনে নজিরবিহীনভাবে সরকারি দলকে হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বিপরীতে সাধারণ মানুষ, যাঁরা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কাতর, তাঁদের করমুক্ত আয়সীমা একটি পয়সাও বাড়েনি। আগামী বছরও বাড়বে না, সেই ঘোষণা আগাম দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটে আরও দেখা গেল, কালোটাকার মালিকদের শুধু ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁরা বৈধ আয়ে নিয়মিত কর দেন, তাঁদের কর দিতে হবে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ হারে। এটা যে ব্যবসায়ীদের জন্যই করা হয়েছে, তা সরকারই জানিয়ে দিচ্ছে।

বাজেটে সোনার বার বিদেশ থেকে বৈধ পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিয়ম কঠোর করা হয়েছে। প্রবাসীরা এখন আর নতুন দুটি মুঠোফোনও নিয়ে আসতে পারবেন না। পুরোনো দুটি ও নতুন একটি। সেটিতে কর দিতে হবে। সোনা ও মুঠোফোন আনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আনার দাবি ছিল প্রভাবশালী গুটিকয় ব্যবসায়ীর। লাখ লাখ প্রবাসীর বিপক্ষে গিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবি পূরণে সরকার দরাজহস্ত।

বাজেটের আগে আমরা দেখলাম, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য অনেকটা লুকোচুরি করে দেড় কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হলো। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অগ্রাধিকারে রাখা হলো গুলশান ও বনানীতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পকে।

বিপরীতে আমরা দেখলাম, ঢাকা ওয়াসা পানির দাম আবারও ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ল ১৬ বার।

বাজেটে রাজস্ব বাড়াতে সরকার বেছে নিয়েছে মুঠোফোন সেবাকে। নতুন করভার ৩৯ শতাংশ। কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, মুঠোফোন সেবার ওপর কর বাড়ছে। কোম্পানিগুলো বাজেটের আগেই বলেছে, তারা যে রাজস্ব আয় করে, তার ৫৪ শতাংশ সরকার নিয়ে নেয় বিভিন্ন কর ও ফি বাবদ।

মুঠোফোনে কর আরোপ হলে তা দরিদ্র ও ধনীদের ক্ষেত্রে সমান হয়। যে শ্রমিক দম্পতি সন্তানকে বাড়িতে রেখে সাভারের পোশাক কারখানায় শ্রম বিক্রি করেন, তাঁদের ওপর এত কর কেন? তাঁরা কি মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভিডিও কলে সন্তানকে দেখবেন না?

মুঠোফোন সেবা থেকে কর আদায় সহজ, কিন্তু অভিজাত এলাকার ভবনমালিকদের কাছ থেকে কর আদায় কঠিন। কারণ, তাঁরা আয়কর নথিতে জমির দাম দেখান পাঁচ-ছয় দশক আগের। ফলে সম্পদ–কর (ব্যক্তির সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর) আদায় হয় না। ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয় প্রকৃত দামের চার ভাগের এক ভাগ। যেমন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ গুলশানে চারটি ফ্ল্যাটের দাম দেখিয়েছেন সোয়া দুই কোটি টাকার মতো। গুলশানে প্রকৃত দর অন্তত আট গুণ।

নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সংস্কার এনে, প্রগতিশীল করব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় হবে। করের বাইরে থাকা মানুষকে করজালে আনা হবে। বাড়ানো হবে দরিদ্রদের ভাতা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যে খাতে বরাদ্দ।

কিন্তু নতুন সরকারের নতুন বাজেটে নতুন কিছুই দেখা গেল না; বরং কর আদায়ের জন্য বেছে নেওয়া হলো মুঠোফোন, ব্যাংকে জমা রাখা টাকা, গৃহে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক বাতি, আমসত্ত্ব, ফলের রস, মেট্রোরেল ও লন্ড্রি সেবাকে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যাংকে টাকা জমা রেখে যে সুদ আয় করে, তা-ও বাদ দেননি অর্থমন্ত্রী। বাদ পড়েনি বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসাযন্ত্রও।

বাজেটের কারণে দাম বাড়বে, এমন পণ্যের তালিকা দীর্ঘ এবং পণ্যগুলোর ব্যবহার বেশি। কমবে, সেই তালিকা ছোট। নিত্যপণ্য আমদানিকারকদের অগ্রিম আয়করে ছাড় দিয়ে অর্থমন্ত্রী বাহবা পেতে পারেন, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই মানুষ এর সুফল পাবেন না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বাজেটে অগ্রাধিকারে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে সেটা কমে সাড়ে ৬ শতাংশে নামবে। এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু বাজেটের বই খুঁজে তেমন কোনো পদক্ষেপ পাওয়া গেল না, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম, গরুর মাংস—এসবের দাম কমবে কীভাবে?

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নতুন বাজেটে আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন নতুন কিছু নেই, কিন্তু করের চাপ আছে। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে আরও টাকা নিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ আছে।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সোমবার নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বলেছেন, করনীতি দেখে মনে হয়, বাঘের হরিণ শিকার করার নীতিতে চলছে রাজস্বব্যবস্থা; অর্থাৎ ছোট ও ক্ষমতাহীনদের চাপে রাখা হচ্ছে।

বাজেটে অন্তত একটি পদক্ষেপ নেওয়া যেত। এটা মূল্যস্ফীতি কমাতে বড় ভূমিকা রাখত। সেটি হলো ডিজেলে শুল্ক-কর কমিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি তেল থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়করবাবদ সরকার পেয়েছে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গত এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসি প্রায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। মুনাফা ও কর অর্ধেকে নামিয়ে এনে ডিজেলের দাম অনেকটা কমিয়ে দিলে দেখা যেত, পণ্য পরিবহন খরচ, কৃষির খরচ, পরিবহনভাড়া কমে মূল্যস্ফীতি কমে যাচ্ছে।

ভারতের বিরোধী দল বনাম বাংলাদেশের বিরোধী দল

ভারতে বিরোধী দলগুলো জনগণের সমস্যাকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এনে ‘মোদি ম্যাজিক’কে ফিকে করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দল আসলে সরকারেরই অংশ। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোট করেছে। তাদের জোরালো অবস্থান নেওয়ার নৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক শক্তি নেই।

সরকারের বাইরে বিরোধী দল বিএনপির জনঘনিষ্ঠ তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। তারা আছে নির্বাচনের পদ্ধতি ও নিজেদের বিরুদ্ধে হওয়া হাজার হাজার মামলা নিয়ে। বাম দলগুলো ‘বিপ্লব করা থেকে ইস্তফা’ দেওয়ার পর নিম্ন আয়ের মানুষের কোনো কণ্ঠস্বরও নেই। ওদিকে সরকার বারবার বলছে, মানুষ ভালো আছে। সামনে আনা হচ্ছে সেন্ট মার্টিনে ঘাঁটি ও খ্রিষ্টান রাজ্যের মতো বিষয়গুলো। বিদ্যুতের কথা, জ্বালানি তেলের কথা, ডিমের ডজন ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো নয়।

ভারতের উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী দলের সভাপতি অখিলেশ যাদব এবার তাঁর নির্বাচনী রণনীতি সাজিয়েছিলেন পিছিয়ে থাকা মানুষের কথা মাথায় রেখে। এককথায় এর নাম হয়েছিল ‘পিডিএ—পিছরা, দলিত ও অল্পসংখ্যক’। প্রার্থীদের মধ্যে রেখেছিলেন মোটামুটি সব জাতপাতের প্রতিনিধি। তাঁদের সমস্যার কথাই বেশি সামনে এনেছিলেন। এই রণনীতি বাজিমাত করেছে। ভোটে হিন্দুত্ববাদের ঘাঁটিতে বিজেপি খুবই বাজে ফল করেছে। চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমারের দলও পিছিয়ে থাকা মানুষের সঙ্গে থেকে ভালো ফল করেছে।

বাংলাদেশে দরিদ্র ও পানিতে পুরো শরীর ডুবিয়ে কোনোরকমে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কথা কে বলবেন?

  • রাজীব আহমেদ, প্রথম আলোর ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং (অনলাইন)