মৃণালিনী দেবী তাঁর পতিদেব রবীন্দ্রনাথের প্রতি লিখেছিলেন: ‘এখন আমি মহাকালের শেষহীন পথে নির্জন একাকী।...শত কথার ভিড়, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি মহালোকের অনন্ত শূন্যতায় বুকের ওপর চেপে বসেছে!’ শত বছর পরে আরেক মৃণালিনীর জন্যই যেন সত্য হয়ে গেছে এ শূন্যতা। ছয় ছেলে হারিয়ে ‘শেষহীন পথে নির্জন একাকী’ এক বিধবা।
মৃত্যুর পর মৃত্যুতে আমাদের সড়কগুলো যেন হয়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্রের লাশের পাহাড়ের মতো। সেই লাশের পাহাড় ডিঙানো সম্ভব না হলেও কিছু চেহারা ঠিকই আমাদের মনে গেঁথে যায়। কিছু কিছু লাশ বা ঘটনা প্রতীকী রূপ ধারণ করে এবং আমাদের মনে খচখচ করে বিদ্ধ করে যায়। কারওয়ান বাজার মোড়ে দুই বাসের মাঝখানে আটকে যাওয়া বিচ্ছিন্ন হাতের ছবি নিশ্চয়ই ভোলার নয়। হ্যাঁ, রাজীবের সেই হাত। একইভাবে সেই শিশু, ময়মনসিংহের ত্রিশালের রাস্তায় নিহত মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সেই ফাতিমাকেও।
আমাদের সমাজমনস্তত্ত্বে একটি বিষয় লক্ষণীয়, যত বেশি নিষ্ঠুরতা, তত বেশি আলোচিত, তত বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু পত্রিকায় ছাপানো সড়ক দুর্ঘটনার একটি শান্ত ও শীতল ছবির ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহতা আমাদের মুহূর্তের মধ্যে নির্বাক করে দেয়। সাদা শাড়ি পরা পাঁচজন সদ্য বিধবা নারী এবং মাথা মুড়ানো তিনজন এতিম নাবালক ছেলের দাঁড়িয়ে থাকার এই ছবিটি সড়কে নৈরাজ্যের আজীবন এক প্রতীকী ছবি হয়ে থাকবে।
দেশে ও বিদেশে ‘বিধবাদের গ্রাম’ নামে কত গ্রামের নামে আমরা পরিচিত হয়েছি। কিন্তু চট্টগ্রামের চকরিয়ার মালুমঘাটেই দেখা মেলে ‘বিধবাদের ঘর’। মৃণালিনী সুশীলেরই ঘর সেটি। সড়কে ছয় সন্তান হারানো এই মা দশ দিন আগে স্বামী হারিয়ে নিজেও বিধবা। গোটা পরিবার নিয়ে স্বামীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে সড়কেই সন্তানদের লাশ হতে দেখেছিলেন। শীতের সেই সাদা কুয়াশামাখা রক্তাক্ত ভোর যেন ভুলতে পারেন না কখনো।
অনন্ত শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা মৃণালিনীকে ‘ভাগ্যবতী’ বলতেই হয়। সড়কে এক মৃত্যুর ২০ বা ৩০ বছর পর একইভাবে পরিবারের আরেক সদস্যের মৃত্যু হচ্ছে, এমন বাস্তবতাও যখন কিছুদিন পরপর সত্য হয়ে উঠছে; সেখানে আমাদের বিচারব্যবস্থার নিরিখে ‘খুব অল্প সময়ের’ মধ্যে ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর বিচারের রায় হলো। রায়ে সম্ভবত কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আদালত থেকে এই প্রথম এমন বক্তব্য এল—এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ, পিকআপচালক প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর ফিরে এসে আবারও চাপা দিয়ে মৃণালিনীর সন্তানদের হত্যা নিশ্চিত করেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য চালকের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা থাকলেও বয়স বিবেচনায় তরুণ চালককে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিচারক।
২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার হন পিকআপের মালিক। দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ইতিহাসে ঘাতক পরিবহনের মালিককে গ্রেপ্তারের ঘটনা বিরলই বটে। মালিক জামিন পেলেও তাঁর ছেলে এখনো পলাতক। সেই ছেলে সেদিন চালকের পাশের আসনেই ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এসব পিকআপ রাস্তায় চলাচলের ‘অনুমতি’ পায় বলেই মৃণালিনীদের বুক খালি হলো। বিধবা হলেন ছয় নারী। এতিম হলো কয়েকজন শিশু। এখন এতসব ‘ঘাতক’ রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে শুধু চালককে সাজা দিলে কি বিচার হয়ে যাবে? ফিটনেস সনদ, লাইসেন্স বা রুট পারমিটবিহীন গাড়ি যারা রাস্তায় চলার নিরাপত্তা দেয়, তাদের বিচার না হলে এসব শাস্তি হয় সান্ত্বনামূলক না হয় উপহাসমূলক পুরস্কার।
আমরা জানি না, তাঁর প্ররোচনাতেই চালক পেছনে ফিরে মৃণালিনীর সন্তানদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছিলেন কি না অথবা চালককে এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন কি না। তবে আমরা জানতে পারছি, মালিক ও তাঁর ছেলের বিচার হবে সড়ক পরিবহন আইনে। যদিও আমাদের স্মরণে আনতে কষ্ট হয়, সড়কে এমন হত্যাকাণ্ডে সর্বশেষ কখন পরিবহনমালিককে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল।
এ দেশে কঠোর সড়ক আইন থাকলেও পরিবহনমালিককে এখানে দায়মুক্তি দিতে সদা তৎপর থাকে সব পক্ষ। সব দোষ তখন ঘাড়ে এসে পড়ে চালকের ওপর। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ঠিকই; কিন্তু পুলিশ তাঁদের খুঁজে বের করতে পারে না। এর একটি চিত্র পাওয়া যায় রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। চালককে শনাক্ত না করেই এখানে সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত শেষ করা রেওয়াজ হয়ে উঠছে। ঢাকায় আড়াই বছরে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে প্রায় ৫০০টি মামলা হলেও ৪২ শতাংশ মামলায় চালককে খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। এতে পুরো দেশের চিত্র কেমন হবে, সেটি অনুমান করা যায়। এখানে কোনো ‘রহস্য’ লুকিয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এখন চালকের শাস্তিতে কি বাকিরা নিস্তার পাবেন? পিকআপের মালিক একজন অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে গাড়িটি তুলে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও মালিক আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। ওই পিকআপের ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, রুট পারমিট কিছুই ছিল না। তার মানে এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় ঘাতক মালিকই। হত্যায় অংশগ্রহণ না করলেও নির্দেশদাতা বা পরিকল্পনাকারীর মতোই নয় কি বিষয়টি? তাহলে চালকের ফৌজদারি আইনে বিচার হলে মালিকের কেন নয়? এতে পরিবহনমালিকেরা খেপে যাবেন বলে?
কক্সবাজারের নয়টি উপজেলার মধ্যে সাতটিতে সড়ক-উপসড়কে প্রায় দুই হাজার অবৈধ ডাম্পার (ছোট ট্রাক) ও পিকআপ চলাচল করে। কক্সবাজারের পাহাড়, ঝিরি-খাল, নদী খুবলে বালু-মাটি-গাছ নিয়ে যায় এসব অবৈধ যানবাহন। কোনো ফিটনেস সনদ বা চালকের লাইসেন্স কিছুই লাগে না। বেশির ভাগ চালকও অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রশিক্ষিত। হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশ সহজেই ম্যানেজ হয়ে যায়।
এসব পিকআপ রাস্তায় চলাচলের ‘অনুমতি’ পায় বলেই মৃণালিনীদের বুক খালি হলো। বিধবা হলেন ছয় নারী। এতিম হলো কয়েকজন শিশু। এখন এতসব ‘ঘাতক’ রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে শুধু চালককে সাজা দিলে কি বিচার হয়ে যাবে? ফিটনেস সনদ, লাইসেন্স বা রুট পারমিটবিহীন গাড়ি যারা রাস্তায় চলার নিরাপত্তা দেয়, তাদের বিচার না হলে এসব শাস্তি হয় সান্ত্বনামূলক না হয় উপহাসমূলক পুরস্কার।
● রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী