মতামত

তিস্তার পানি যা আসত, তা–ও আর আসবে না?

৪ মার্চ কলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি উদ্বেগজনক খবর বেরিয়েছে (বেঙ্গল’স পুশ ফর টু মোর ক্যানেল আন্ডার তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট)। এর আগের দিন জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন ১ হাজার একর জমি হস্তান্তর করেছে পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের কাছে। উদ্দেশ্য, তিস্তার বাম তীরে আরও দুটি নতুন খাল খনন করা, যাতে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলার আরও কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল তিস্তা এবং সেই সঙ্গে জলঢাকা নদীর পানি নিয়ে আসবে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত। বাম তীরে অপর খালটি হবে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। অতিরিক্ত এক লাখ কৃষকের জমিতে সেচ-সুবিধা দেবে এই প্রকল্প। তবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এক দশকের অধিক সময় ধরে অপেক্ষমাণ বাংলাদেশ এতে আরও ক্ষুব্ধ হতে পারে, বলছে প্রতিবেদনটি।

টেলিগ্রাফ-এর এই খবর বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে আসছে। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অহরহ বলে আসছিলেন যে তিস্তায় পানি নিতান্তই অপ্রতুল, বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো কোনো পানি নেই। (দুঃখজনকভাবে আমি লক্ষ করেছি যে বাংলাদেশের কিছু ‘বিশেষজ্ঞ’ও তাঁদের এই বক্তব্যের সঙ্গে সুর মেলান)। কথা হচ্ছে, পানি যদি না-ই থাকবে, তাহলে আরও খাল দিয়ে কী হবে? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপ তাদের বক্তব্যের অসত্যতাই প্রমাণ করে। কমবেশি যা-ই হোক, পানি আছে, কিন্তু তার পুরোটাই তাঁরা ব্যবহার করতে চান।

দ্বিতীয়ত, আমরা জানি যে ভূমি অধিগ্রহণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ভূমি হস্তান্তর করতে বিস্তর সময় লাগে। অর্থাৎ, তিস্তা নিয়ে যখন বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে আলাপ-আলোচনা, মনোমালিন্য চলছে, পাশাপাশি তখন ভারত তিস্তার পানির ব্যবহার আরও বাড়ানোর প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে নিঃশব্দে। নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের অধিকার এবং এ নিয়ে স্পর্শকাতরতা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের স্পর্শ করেনি।

উত্তরবঙ্গের বিশাল এক জনগোষ্ঠী তিস্তার পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। তাদের দুর্দশা লাঘবে যা প্রয়োজন, বাংলাদেশকে তা করতে হবে। ভারতের যদি তাতে সমস্যা থাকে, তবে বাস্তবসম্মত বিকল্প সমাধান দিক ভারত। বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ খুশিমনে সেটা মেনে নেবে। 

তৃতীয়ত, জলঢাকা নদী শিঙ্গিমারী নামে জলপাইগুড়ি জেলা থেকে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে প্রবেশ করে কুড়িগ্রাম জেলায় ধরলা নামে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। আশঙ্কা, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুকনো মৌসুমে যত্সামান্য যা পানি জলঢাকা থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হতো, তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে।

এ কথা সবাই জানেন যে বাংলাদেশ ভারত অভিন্ন নদীগুলোর পানিপ্রবাহের মৌসুমি পার্থক্য খুবই বেশি। বর্ষাকালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমের প্রবাহ প্রায়ই এক-দশমাংশ বা তার থেকেও কম, যা দুই দেশের কাঙ্ক্ষিত প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তিস্তা এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বব্যাপী পানি ভাগাভাগির মূল বিষয়টিই হচ্ছে এই অভাব এবং অভাবপ্রসূত কষ্টকে ভাগ করে নেওয়া। বন্ধুদেশ তো বটেই, এমনকি বন্ধুভাবাপন্ন নয় এমন দেশও নদীতে অপ্রতুল পানির কষ্টকে পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে নেয়।

২০১১ সালে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের একটি সাময়িক চুক্তির খসড়া করতে সম্মত হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে সে চুক্তি চূড়ান্ত স্বাক্ষর সম্ভব হয়ে ওঠেনি পরবর্তী এক যুগে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে চুক্তিটি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের জন্য। ভারতীয় পক্ষ প্রথম প্রথম কিছু আশাব্যঞ্জক বক্তব্য দিলেও একসময় তা থেকে সম্পূর্ণ সরে আসে এবং সম্প্রতি তিস্তা নিয়ে ভারত একরকম মৌনব্রতই অবলম্বন করছে।

বাংলাদেশ তাহলে কী করতে পারে তিস্তা নিয়ে ভারতের এই একতরফা কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে? বাস্তবতা হচ্ছে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য ভারতকে অনুরোধ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার সুযোগ নেই বাংলাদেশের। ভারত যা করেছে, তা বাংলাদেশের প্রতি শত্রুতাবশত করেনি, করেছে নিজের স্বার্থেই। তবে এর ফলে বাংলাদেশের ওপর কী বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, সেটি তারা বিবেচনায় নেয়নি। সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ যখনই কিছু করতে যায়, প্রথমেই তাকে চিন্তা করতে হয়, এর ফলে ভারতের কোনো সমস্যা হবে কি না বা ভারতের কোনো আপত্তি আছে কি না। এ কারণেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে বাংলাদেশকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল।

সেটি চীনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। পেছাতে হয়েছিল পদ্মা ব্যারাজ প্রকল্প থেকেও। তিস্তার পানি যেহেতু ভারত দেবেই না, আংশিক সমাধানের জন্য তিস্তায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখার একটি সম্ভাব্য প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে আলাপচারিতার কথা শোনা গিয়েছিল। হঠাৎ করেই তা আবার চাপা পড়ে যায়। অনেকে মনে করেন, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডরের এত কাছে দীর্ঘদিন ধরে চীনা বিশেষজ্ঞরা কাজ করতে থাকবেন, এটা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় বলেই এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না।

তিস্তায় প্রস্তাবিত বাঁধের উপযোগিতা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত মতামত দিতে পারেন মুক্তমনা হাইড্রোলজিস্টরা (পানিবিজ্ঞানবিদ)। যদি দেখা যায় যে প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য এবং লাভজনক, তবে তা নিয়ে বাংলাদেশের এগোনো উচিত ভারতকে জানিয়েই।

উত্তরবঙ্গের বিশাল এক জনগোষ্ঠী তিস্তার পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। তাদের দুর্দশা লাঘবে যা প্রয়োজন, বাংলাদেশকে তা করতে হবে। ভারতের যদি তাতে সমস্যা থাকে, তবে বাস্তবসম্মত বিকল্প সমাধান দিক ভারত। বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ খুশিমনে সেটা মেনে নেবে। 

  • মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব