এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে টানা কয়েক দিন রাজধানীর পোশাকের বাজারগুলোয় অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। নামীদামি ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে মিরপুর বেনারসিপল্লি এবং অখ্যাত শোরুমেও অভিযান চলে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজ থেকে এ সব অভিযানের ভিডিও নিয়মিতই আপলোড করা হয়। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজ আর ইউটিউব চ্যানেলের কল্যাণে দেখতে পেয়েছি। সাসপেন্সে ভরা ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়। ভিডিওগুলো দেখে এ-ই ভেবে আশাবাদী না হয়ে ওঠার উপায় নেই যে বাংলাদেশের সৃষ্টিছাড়া বাজারব্যবস্থায় কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা চলছে। ক্রেতা বা ভোক্তাকে ঠকানোর কারণে চাপের মুখে পড়ছে অসাধু বিক্রেতারা আর তাতে যৌক্তিক দামে পোশাক কিনতে পেরেছে তারা!
ভোক্তা অধিকারের ফেসবুক পেজে আপলোড করা ভিডিওর কয়েকটি শিরোনাম বেশ আকর্ষণীয়। শিরোনাম দেখেই দর্শকের আগ্রহ হবে ভিডিওতে ঢুকতে। যেমন ‘কাপড় বিদেশি কিন্তু বিক্রেতা জানে না কোন দেশি!!’ , ‘ইচ্ছেমতো পোশাকের মূল্য নির্ধারণ যৌক্তিক কি না??’ , ‘শাড়ি-পাঞ্জাবিতে কত লাভ করা উচিত???’, ‘এক শাড়িতে এত লাভ করতে হবে??’, ‘শাড়ির মূল্য কত হবে!’ ।
অধিকতর প্রশ্ন আর অধিকতর বিস্ময়বোধের কারণেই হয়তো শিরোনামগুলোর শেষে দুই বা ততোধিক প্রশ্ন বা বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। তদারকি সংস্থারই যখন এত এত প্রশ্ন, এত এত বিস্ময়, তখন আমরা আম-ভোক্তা তাদের তো প্রশ্ন-বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকার কোনো কারণ নেই।
বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে সবার আগে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আবার বাজারে যাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা চালু থাকে, সে জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো সংস্থার ভূমিকা থাকে। প্রতিষ্ঠান ও আইন থাকার পর তাদের সে ভূমিকায় তো দেখা যায় না। বাজার তদারকির জন্য ভোক্তা অধিকার একটি অংশমাত্র। তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু ভ্লগ বানিয়ে বাজার তদারকি দেখে স্টার জলসার ‘তিতলি’ সিরিয়ালের সেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘তিতলি কি পারবে?’ -এর মতোই মনে হচ্ছে, ‘ভোক্তা অধিকার কি পারবে?’
ভোক্তা অধিকারের ভিডিওগুলো পরিকল্পিতভাবেই তৈরি করা। কেননা, একটা ভিডিও তৈরি করতে যে ধরনের আয়োজন দরকার, তার প্রায় সবটাই আছে। সেগুলো হাল জামানার জনপ্রিয় ভিডিও ব্লগ বা ভ্লগের সমতুল্য। এর পেছনে নিশ্চয়ই তাদের উদ্দেশ্য, বিধেয়, পরিকল্পনা—সবই আছে। মানছি, সেসব গূঢ় রহস্য জানার বৃথা চেষ্টা খুব কাজের কিছু নয়। কিন্তু ভোক্তা হিসেবে আমাদের সামান্য হলেও তো চাওয়াটা থাকেই। আমরা যেন প্রতারিত না হই, ভেজাল-দুই নম্বর জিনিস আমরা যেন ঘরে নিয়ে না আসি, যৌক্তিক দামে আমরা যেন জিনিসপত্র কিনতে পারি—ব্যস, এতটুকুই চাওয়া। কিন্তু এত আয়োজন করে অভিযান আর ভ্লগ বানানোর পর সেই এতটুকু চাওয়া কি পূরণ হচ্ছে?
ভোক্তা অধিকারের ভিডিওর কল্যাণে পোশাকের বাজারে নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো কতটা মুনাফা করে, তার একটি বুক চিনচিন করা চিত্র ধরা পড়ে। ছেলেদের শার্ট, মেয়েদের শাড়ি কিংবা অন্য পোশাকে ৪০,৫০, ৬০, আবার কোথাও কোথাও ১০০ শতাংশই লাভ করা হচ্ছে। এ লাভের ওপরেই কেউ কেউ ছাড় আবার কেউ কেউ ক্যাশব্যাক অফার দিচ্ছে। ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা বিক্রয়কর্মীদের কাছে জিজ্ঞাসা করছেন, কেন তাঁরা একটা পোশাক বিক্রিতে এতটা লাভ করছেন? তাঁরা বলছেন, ‘এই যে আপনারা এতটা লাভ করছেন...এটা কি ঠিক?’
এ প্রশ্নে নেহাতই একটা বোকা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক করছে। এই তো নব্বইয়ের দশকে যখন ডিশও আসেনি, আর বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা ঠিকঠাক ঘুরিয়ে শুক্রবার দুপুরের পর বিটিভিতে প্রচারিত সিনেমার দেখার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম, তাদের কাছে আমার সেই বোকা প্রশ্নের একটা মূল্য পেলেও পেতে পারে। বাংলা সিনেমা রূপকথার গল্পের মতোই—‘তারপর একদিন তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করল’ টাইপের। কিন্তু সিনেমার শেষ দৃশ্যের আগের দৃশ্যে আমরা দেখে অভ্যস্ত সারা জীবন ধরে পড়ে পড়ে মার খাওয়া হিরো শেষ পর্যন্ত সব ভিলেনকে ইয়া...ঢিসুমঢিসুম মেরে কুপোকাত করে ফেলছে। কিংবা একেবারে কোনো অলৌকিক কারণে ভিলেনের মধ্যে একধরনের বোধ হয়, শেষ পর্যন্ত অনুশোচনার মধ্য দিয়ে তিনি ভালো হয়ে যান। এসব সাদাকালো আর খানিক রঙিন চলচ্চিত্র দেখেই আমরা অভ্যস্ত। আমাদের মনস্তত্ত্বও সাদাকালোর বাইরে খুব একটা বেশি রঙিন নয়।
ভোক্তা অধিকারের ভ্লগগুলো শেষ হয় বিক্রয়কর্মীদের নথিপত্র নিয়ে পরের দিন সকালে ভোক্তা অধিকারের দপ্তরে দেখা করার কথা বলার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা ভোক্তারা জানতে পারি না, এরপর কী হয়। ৪০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ, ৬০ শতাংশ লাভ করা ঠিক না বেঠিক, তা তো আমরা আম-ভোক্তারা জানতে পারি না। কোনো অলৌকিক মন্ত্রবলে তাঁরা বদলে যান কি না, তা-ও আমরা জানতে পারি না।
কোথাও কি একটা শুভংকরের ফাঁকি থেকে যাচ্ছে? এখানে সমীকরণটা কিন্তু খুব সরল। এই ভ্লগ শেষ পর্যন্ত দর্শকদের ভিউ পাওয়া ছাড়া পণ্যের দাম কমাতে মোটেই ভূমিকা রাখার কথা নয়। কারণ, সর্বেসর্বা সেই বাজার। একজন ব্যবসায়ী একটা শার্টে, একটা টি-শার্টে, একটা শাড়িতে, একটা সালোয়ার-কামিজে কিংবা অন্য কোনো পণ্যে কত টাকা লাভ করবেন, তার নির্দিষ্ট কোনো সূত্র নেই।
হ্যাঁ, যৌক্তিক মুনাফা বলে একটা ব্যাপার চালু আছে। পণ্যের ক্রয়মূল্য, দোকানভাড়া, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিল, চাঁদা—এসব খরচ যোগ করে তারপর একটা যৌক্তিক মুনাফা করা। কিন্তু সেটাও তো ব্যবসায়ীর নৈতিকতা আর মর্জির ব্যাপার। চাইলে কেউ শতভাগ লোকসান দিয়েও বিক্রি করতে পারেন। আবার তিনি চাইলে ৪০,৫০, ৬০,১০০, ২০০ কিংবা আরও বেশি লাভ করতে পারেন। এই লাভের কারণে কোনো ব্যবসায়ীকে আইনের মারপ্যাঁচে ধরা যায় না। বড়জোর যাত্রাপালার বিবেকের ভূমিকায় নেমে বলা যায়, ‘৪০,৫০, ৬০ ভাগ লাভ...এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
বাজার আসলে চাহিদা আর জোগানের চিরন্তন সূত্র অনুযায়ী চলে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে অকেজো বাজারগুলোর একটি। এখানে একজন মুদিদোকানিও কারসাজি করে বাজার অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে সবার আগে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আবার বাজারে যাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা চালু থাকে, সে জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো সংস্থার ভূমিকা থাকে। প্রতিষ্ঠান ও আইন থাকার পর তাদের সে ভূমিকায় তো দেখা যায় না। বাজার তদারকির জন্য ভোক্তা অধিকার একটি অংশমাত্র। তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু ভ্লগ বানিয়ে বাজার তদারকি দেখে স্টার জলসার ‘তিতলি’ সিরিয়ালের সেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘তিতলি কি পারবে?’ -এর মতোই মনে হচ্ছে, ‘ভোক্তা অধিকার কি পারবে?’
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী