আলজাজিরা ও টিকটকের লোগো
আলজাজিরা ও টিকটকের লোগো

মতামত

আল–জাজিরা বন্ধ ও টিকটক নিষিদ্ধ করার পেছনে কি একটাই কারণ

এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের পার্লামেন্টে যখন আল–জাজিরা নিষিদ্ধের উদ্যোগ চলছিল, তখন হোয়াইট হাউস খুব ‘সঠিকভাবেই’ বলেছিল, এতে তারা ‘উদ্বিগ্ন’। গত রোববার ইসরায়েল আল–জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। দ্য ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন ইসরায়েলের এ পদক্ষেপকে বলেছে, ‘গণতন্ত্রের জন্য অন্ধকার একটি দিন’।

হোয়াইট হাউস অবশ্য ‘উদ্বেগ’ প্রকাশের জন্য অদ্ভুত একটা পথ বেছে নিয়েছে। জো বাইডেন ও তাঁর প্রশাসন সম্প্রতি এমন কতগুলো সেন্সরশিপ আইন ও আদালতে চলমান মামলায় সমর্থন ও উৎসাহ দিয়েছে, যেগুলো কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য ‘কালো দিন’ নিশ্চিত করেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত দৃষ্টান্তটি হচ্ছে, গত মাসে জো বাইডেন টিকটক নিষিদ্ধ অথবা জোর করে বিক্রি করতে বাধ্য করার বিলে স্বাক্ষর করেছেন। ইসরায়েল যেমন করে আল–জাজিরা নিষিদ্ধ করেছে, ঠিক তেমন করে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি আসছে, এমন অপ্রমাণিত দাবির ওপর ভিত্তি করে বাইডেন প্রশাসন টিকটক নিষিদ্ধ করেছে।

আল–জাজিরা বন্ধ ও টিকটিক নিষিদ্ধ দুই আইনের ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ মিল খোলাখুলিভাবে দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে যে ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, সেটা থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

আল–জাজিরা বন্ধ ও টিকটিক নিষিদ্ধ দুই আইনের ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ মিল খোলাখুলিভাবে দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে যে ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, সেটা থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করাই শেষ ঘটনা নয়। এ আইন ভবিষ্যতে অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করার দরজা খুলে দিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে পারে বিদেশি সাংবাদমাধ্যমগুলোর স্থানীয় শাখাগুলো। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি বলে মনে করেন।

ইসরায়েলের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, এ ধরনের আইন প্রয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বা সরকারের অনুমোদন দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এরতরফাভাবে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধই যে শেষ ঘটনা, তা বলা যাবে না।

বাইডেন প্রশাসন অবশ্য এখানেই থেমে নেই। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি গোয়েন্দা কার্যক্রম ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইন রিফরমিং ইন্টেলিজেনস অ্যান্ড সিকিউরিং অ্যাক্টে (আরআইসিএএ) স্বাক্ষর করেছেন।

এই আইন অনুসারে সরকার, যেকোনো সার্ভিস প্রোভাইডার যারা তার অথবা ইলেকট্রনিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ অথবা মজুতের সঙ্গে যুক্ত, বাধ্যতামূলকভাবে তাদের তথ্যভান্ডারে প্রবেশের অধিকার পাবে। বিদেশি লক্ষ্যবস্তু নজরদারির জন্যই এই আইন।

এই আইন পাসের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে যে ঐক্যমত্য, সেটা উপেক্ষা করেছে। সিনেটর রন ওয়াইডেনের মতো আইনপ্রণেতারদের সতর্কবার্তাকেও তারা উপেক্ষা করেছে। রন ওয়াইডেন আরআইসিএএ নিয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, এই আইন পাস হলে সরকারের,  ‘একজন কর্মচারী যে কি না, কোনো একটা কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নৈশপ্রহরী, তিনিও সার্ভারে ইউএসবি ডিভাইস প্রবেশ করানোর সুযোগ পাবে।’

আর সেই কার্যালয়টি হতে পারে, একটা সংবাদমাধ্যমের বার্তাকক্ষ।  আরআইসিএএ হচ্ছে ফরেন ইন্টেলিজেনস সার্ভিলেন্স অ্যাক্টের সংশোধনী। এই আইন আগে থেকেই সাংবাদিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করা হতো।

প্রতিনিধি পরিষদে সম্প্রতি আরেকটি আইন পাস হয়েছে, যেখানে অর্থমন্ত্রীকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, অলাভজনক সংবাদমাধ্যমসহ যেকোনো অলাভজনক সংস্থার কর অব্যাহতির সুযোগ বাতিল করে দেওয়ার। অর্থমন্ত্রী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থনদাতা সংস্থা’ বলে গণ্য করতে পারবেন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এরই মধ্যে অবৈধ।

তাহলে নতুন করে এই আইন পাসের দরকার কেন হলো? তার কারণ হলো, একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হবে এবং কোন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের আওতায় আনা  হবে, তার বিশদ বিবরণ সেখানে দেওয়া  হয়েছে।

আইনটি এমন এক সময়ে পাস হলো, যখন কেন্দ্রীয় আইনপ্রণেতা ও রাজ্য পর্যায়ের অ্যাটর্নি জেনারেলরা সিএনএন, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, নিউইয়র্ক টাইমস ও রয়টার্সের মতো প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের দিকে কটাক্ষ করে বলছেন যে, সেগুলো সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফিলিস্তিনি ফ্রিল্যান্সারদের কাছ থেকে তারা ছবি কিনছে, কিংবা ইসরায়েলের সমালোচনা করা হচ্ছে, এমন আধেয় কিনছেন।

কিছু কিছু বিশ্লেষক তো আগ বাড়িয়ে এটাও বলছেন যে এই বিলে তাঁদের তালিকাবদ্ধ করা হোক, যাঁরা আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট স্মরণ জোটের বিতর্কিত আন্টিসেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষ সংজ্ঞা মেনে চলছে না। এই সংজ্ঞা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা গ্রহণ করেছে। ইসরায়েলের সমালোচনা এ ক্ষেত্রে ইহুদিবিদ্বেষ বলে গণ্য হতে পারে।

এই বিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সংবাদমাধ্যমগুলোকে নীরব করিয়ে দিতে অনেক বড় ক্ষমতা দেবে। বিশেষ করে অলাভজনক সংবাদমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে সেটা বড় হুমকি। যদিও বাইডেন প্রশাসন এখনো নিশ্চিত করেনি, তারা নন-প্রফিট বা অলাভজনক সংস্থা সম্পর্কিত বিলটি সমর্থন দেবে কিনা। কিন্তু প্রশাসন এরই মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়, এমন সব সেন্সরশিপ আইনে স্বাক্ষর করেছে, যেটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।

বাইডেন ও অন্যান্য ডেমোক্র্যাট নেতারা অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসকের মতো আচরণ করবেন। আর বাস্তবে তারা এমন সব কাজ করছেন, যেটা কি না নিপীড়নের জন্য ট্রম্পের হাতকেই শক্তিশালী করবে। নির্দিষ্টভাবে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে প্রিয় বলির পাঠা হয়ে উঠবে।

  • সেথ স্ট্রেন ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অব অ্যাডভোকেসি

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত