সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা হয়ে উঠেছে ভারত আর চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা হয়ে উঠেছে ভারত আর চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।

নতুন শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ভারতের চ্যালেঞ্জ

আরাগালা নামে জনগণের সংগ্রাম ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ক্ষমতার আসন থেকে সর্বশক্তিমান রাজাপক্ষে ভাইদের পতন ঘটিয়েছিল। লক্ষ্য অর্জনের পরে এই সংগ্রাম ভেঙে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এর উৎস ছিল অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা; কিন্তু তখন জনগণের মধ্যে যে বহাল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, তা স্পষ্টতই বিলীন হয়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই নির্বাচনের ফলাফল।

জনগণের সংগ্রামের ফল পেয়েছে বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। এর নেতৃত্বে আছে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি)। জেভিপির শুরু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলন হিসেবে। তবে তারা পরবর্তীকালে মূলধারায় যোগ দিয়েছে। দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এখন প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে তারা। এনপিপির অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে রাজনৈতিক দুর্নীতি মুছে ফেলে নবজাগরণ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

সংখ্যালঘুদের ক্ষত

অনূঢ়া দিশানায়েকে বিজয়ী হয়েছেন। তবে তাঁর ভোট মূলত এসেছে সিংহলি-অধ্যুষিত দক্ষিণ শ্রীলঙ্কা থেকে। যেখানে তামিল হিন্দু ও মুসলমানেরা বাস করে সেই উত্তর বা পূর্ব থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন তিনি পাননি। বোঝা যাচ্ছে, দেশকে একত্রিত করার যে অঙ্গীকার তিনি করেছেন, তা সফল করতে হলে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ২০০৯ সালে লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের প্রধান প্রভাকরণ শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পরই তিন দশকের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে; কিন্তু এর পরে শ্রীলঙ্কার সরকারগুলো তামিল জনগোষ্ঠীর সেই ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেননি। দেশের সংখ্যালঘুদের ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য অনূঢ়াকে বিশেষ চেষ্টা করতে হবে।

চীনের সঙ্গে এনপিপির ঘনিষ্ঠতা এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে অনূঢ়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের জন্য যে উদ্বেগের কারণ তা অনূঢ়া নিজে ভালো করেই জানেন। ভারত আর চীনের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগী শক্তির সঙ্গে নতুন প্রেসিডেন্ট কীভাবে নিজ দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখবেন, তা দেখার জন্য ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে।

কাঁটার মুকুট পরে ক্ষমতায়

দিশানায়েকে সত্যিই কাঁটার মুকুট পরে ক্ষমতায় এসেছেন। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে যে অর্থনৈতিক পতনের সম্মুখীন হয়েছিল, তা থেকে এখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এখন ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের বোঝা দেশের কাঁধে। অনূঢ়ার প্রথম কাজ হবে দেশের ঋণ মেটানোর জন্য একটি আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে তাঁর প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের বেলআউটের পরবর্তী ধাপের জন্য আলোচনা করতে হবে। এদিকে আইএমএফ সরকারকে জনগণের ওপর ভারী আয়কর আরোপ করতে এবং দেশের রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য অন্যান্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

নির্বাচনী প্রচারের সময় দিশানায়েকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আইএমএফকে তার শর্তের কঠোরতা কমিয়ে আনতে তিনি বাধ্য করবেন; কিন্তু আইএমএফ সহজে শর্ত বদলানোর পাত্র নয়। আবার দেশটি তাদের সহায়তা সমর্থন ছাড়া এখন চলতেও পারবে না। শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে দিশানায়েক স্বীকার করেন যে তিনি কোনো জাদুকর নন এবং ‘সাধারণ জনগণ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরও একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে’ অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার পেতে তাঁকে সাহায্য ও সমর্থন করার।

সামনে কঠিন নির্বাচন

এনপিপির সংসদে মাত্র তিনজন সংসদ সদস্য থাকায়, দিসানায়েকের প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার। তিনি এনপিপির সংসদ সদস্য হরিণী অমরাসুরিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। হরিণী সম্মানিত শিক্ষাবিদ ও নারী অধিকারকর্মী। এই পদক্ষেপ সামনের নির্বাচনে নারীদের ভোট পেতে সহায়তা করবে।

রাষ্ট্রপতির ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা’ রোধ করতে এবং প্রদেশগুলোতে ক্ষমতার ন্যায়সংগত ভারসাম্য নিয়ে আসার জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অনূঢ়ার দল। এর জন্য এনপিপির সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সংশোধন করতে তাদের ২২৫ আসনের মধ্যে তাদের প্রয়োজন হবে ১১৩ আসন। এনপিপির জন্য তা কঠিন কাজ হবে। বিশেষ করে যদি বিরোধী দুই দল আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে।

বাস্তববাদী অনূঢ়া

তার সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও অনূঢ়া যথেষ্ট বাস্তববাদী। তিনি জানেন যে তাঁকে অর্থনীতিকে মন্দা কাটানোর জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এবং দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। নির্বাচনের আগে দলের ইশতেহার প্রকাশের ভাষণে তিনি তিনটি প্রধান অগ্রাধিকারের কথা বলেছিলেন—দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদন সর্বোচ্চ করা এবং চাকরি দেওয়া; অর্থনীতি পুনর্গঠনে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহায়তা প্রদান এবং ম্যানুফ্যাকচারিং, পর্যটন ও সামুদ্রিক শিল্পসহ মূল খাতগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার ওপর জোর দেওয়া। তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতি ভারতের জন্য আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয়। নতুন রাষ্ট্রপতি ‘একটি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল বৈদেশিক নীতি’ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এই নীতি ‘আমাদের আঞ্চলিক জল, স্থল বা বায়ুর এমন কোনো ব্যবহার অনুমোদন করবে না, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং নিশ্চিত করবে যেন সব অর্থনৈতিক লেনদেন দেশের জন্য লাভজনক হয়’।

বাংলাদেশে ভারত এককভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেছিল; কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ভারত সব প্রধান দল ও তাদের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময়, ভারত প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল। সেই কথা অনূঢ়া একাধিকবার ধন্যবাদসহ উল্লেখ করেছেন। এই ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে এসে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফর করেন গুজরাট ও কেরালা। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল আমূল দুগ্ধ সমবায় নিয়ে। শ্রীলঙ্কার দুগ্ধশিল্পে বদল আনার কথা তিনি আগেও বলেছেন।

যেসব চ্যালেঞ্জ ভারতকে ভাবতে হবে

১৯৮০-এর দশকে শ্রীলঙ্কায় ভারতে হস্তক্ষেপ নিয়ে আন্দোলনে, প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন অনূঢ়া। এমনিতেও তাঁর রাজনৈতিক পাঠ শুরু হয়েছে চীনা বিপ্লব দিয়ে। তিনি ও তাঁর দল চীনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। শ্রীলঙ্কায় চীনের নতুন করে প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা ভারতের জন্য চিন্তার বিষয় হবে।

অনূঢ়া সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর বিরোধিতা করেন। এই সংশোধনী তৈরি করা হয়েছিল ভারত-শ্রীলঙ্কার যৌথ আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে। এখানে প্রাদেশিক কাউন্সিল গড়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা আছে। এর মাধ্যমে তামিল সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে ভারত দৃঢ়ভাবে মনে করে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান বিরোধী দলও তা–ই চায়।

ক্ষমতায় আসার আগেই অনূঢ়া বলে দিয়েছেন যে তিনি শ্রীলঙ্কায় গৌতম আদানির বায়ুশক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করবেন। কারণ, তা শ্রীলংকার ‘জ্বালানি সার্বভৌমত্বের’ বিরোধী। এই প্রকল্পের আকার কম নয়, ১০ বিলিয়ন ডলার।

আর সব মিলিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে, রনিল বিক্রমাসিংহের সময় ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধে৵ স্বাক্ষরিত ‘ইকোনমিক পার্টনারশিপ ভিশন’-এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

চীনের সঙ্গে এনপিপির ঘনিষ্ঠতা এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে অনূঢ়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের জন্য যে উদ্বেগের কারণ তা অনূঢ়া নিজে ভালো করেই জানেন। ভারত আর চীনের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগী শক্তির সঙ্গে নতুন প্রেসিডেন্ট কীভাবে নিজ দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখবেন, তা দেখার জন্য ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে। আর জনতার সমর্থন খুবই অস্থির জিনিস। ২০২২ সালের যে আন্দোলন তাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে সেই একই জনতা বিরোধী হয়ে যেতে সময় লাগবে না।

ইন্ডিয়া টুডে থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন