ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি শিশুর লাশ কোলে নিয়ে স্বজনের কান্না
ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি শিশুর লাশ কোলে নিয়ে স্বজনের কান্না

মতামত

ছয়জনের জন্য ইসরায়েলের মাতম, ৪০ হাজার উপেক্ষিত!

ছয় জিম্মি নিহত হওয়ায় ইসরায়েল শোকাহত হয়ে পড়েছে। সারা দুনিয়া জিম্মিদের জন্য শোক করছে। তাঁদের নাম, ছবি, জীবনকাহিনি ও পরিবারের কথা ইসরায়েলে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও সম্প্রচারিত হচ্ছে।

হারেস গোল্ডবার্গ-পলিনস ও ইডেন ইরুশালমি তো তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যশ্বসী হয়ে উঠেছেন—মৃত্যুর আগে (হামাসের বন্দিশালায়) এবং মৃত্যুর পরও। দুনিয়া তাঁদের জন্য কাঁদছে, যা অসম্ভব কিছু নয়। হাজার হোক, ছয়টি তাজা তরুণ প্রাণ, যাঁরা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়ার আগে এক নারকীয় বন্দিদশায় ছিলেন।

কিন্তু আমাদের এই ছয় জিম্মি তো পুরো কাহিনির হিমশৈলের চূড়ামাত্র, যুদ্ধ–আক্রান্ত ব্যক্তিদের খুব ছোট্ট একটা অংশ। তারপরও তাঁদের পরিণতি কেন বৈশ্বিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে, তা–ও বোধগম্য। তবে তাঁদের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে যেভাবে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না তাঁদেরই বয়সী আরও অনেকের ক্ষেত্রে, যাঁরা এই ইসরায়েলি ছয় জিম্মির মতোই ভাগ্যবরণকারী। এই হাজার হাজার নিরপরাধ ও নির্দোষ অভাগা ব্যক্তিরাও ওই ছয়জনের মতোই তাজা তরুণ প্রাণের অধিকারী ছিলেন, যাঁরা জীবন্ত বলি হয়েছেন এবং তাঁরা সবাই ফিলিস্তিনি।

বিশ্ব গাজার পরিণতিতে শোকাহত হয়েছে বটে, কিন্তু কখনোই জীবন্ত বলি হওয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতি অনুরূপ সম্মান বা মর্যাদা প্রদর্শন করেনি (যা করছে ছয় ইসরায়েলি জিম্মির মৃত্যুতে)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তো নিহত ফিলিস্তিনিদের আত্মীয়স্বজনকে টেলিফোন করেননি, এমনকি তাঁদের কেউ যদি গোল্ডবার্গ-পলিনের মতো আমেরিকার নাগরিক হয়েও থাকেন, তাহলেও নয়।

হাজার হাজার অপহৃত ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল বিনা বিচারে আটকে রেখেছে, আর তাঁদের মুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আহ্বান জানায়নি। জাবালিয়ার এক শরণার্থী কিশোরীর (ইসরায়েলি হামলায়) প্রাণ হারানোর ঘটনার তুলনায় নোভা উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে (হামাসের হামলায়) নিহত এক ইসরায়েলি তরুণী দুনিয়াজুড়ে অনেক বেশি সমবেদনা ও সহানুভূতি পেয়েছেন। ইসরায়েল তো ‘বিশ্বের’ সঙ্গে অধিকতর অভিন্ন!

ইসরায়েলের জনপরিসরে ফিলিস্তিনিদের অশেষ যন্ত্রণা ও ভোগান্তিকে উপেক্ষা করা ও লুকিয়ে রাখার বিষয়ে সবকিছু ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। তারপরও যথেষ্ট বলা হয়নি। গাজায় নিহত যে ফিলিস্তিনির চেহারা, নাম ও জীবনের একটি গল্প আছে এবং যাঁর হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলকে শোকাহত করে, তেমন কোনো ফিলিস্তিনির এখনো তো জন্ম হয়নি!

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজা উপত্যকায় এ পর্যন্ত ১৭ হাজার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এই শিশুদেরও আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, ছিল পরিবার—যার সবই তাদের মৃত্যুতে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ইসরায়েলির তাদের প্রতি কোনোই আগ্রহ নেই, বরং অল্প কিছু এই মৃত্যুতে উচ্ছ্বসিত। আর বাইরের দুনিয়ার কাছে তারা ভয়াবহ পরিণতির শিকার হিসেবে বিবেচিত হলেও তাদের নাম বা মুখাবয়ব সেখানেও অনুপস্থিত।

ইসরায়েলিদের হৃদয়জুড়ে কেবল ইসরায়েলি ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা উপস্থিত, যা বোধগম্য, মানবিকও বটে। কিন্তু হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে ছয় জিম্মির মৃত্যু নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে যেভাবে মাতম করা হচ্ছে, তা একটি অসুস্থ ও অনৈতিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ—হাজার হাজার আক্রান্ত মানুষের প্রতি ন্যূনতম মানবিকতার চিহ্ন ছাড়া তাঁদেরকে বিমানবিকীরকরণ। এমনকি যে শিশুগুলো নিহত হয়েছে এবং যে শিশুগুলো বেঁচে থেকেও বাস্তুচ্যুত, এতিম, অসুস্থ, অনাহারী বা পঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের প্রতিও।

তেল আবিব থেকে এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে গেলেই মিলবে হাজার হাজার শিশুর সন্ধান, যাদের প্রতি আমরা তো পুরোপুরি উদাসীন। অথচ ইসরায়েল (হাজার হাজার মাইল দূরে) ফিলিপাইনে সাহায্য দল পাঠায়। জিম্মি ও তাঁদের মৃত্যু নিয়ে ইসরায়েল যত বিলাপ করবে, তত তার জাতীয় শোক এবং ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের প্রতি পরিপূর্ণ অনীহা-অশ্রদ্ধার মধ্যকার অচিন্তনীয় ব্যবধান দৃশ্যমান হবে।

এটা কল্পনা করা মোটেও কঠিন নয় যে গাজাবাসীরা কেমন বোধ করছেন, যখন সারা দুনিয়া ছয় ইসরায়েলি জিম্মির মৃত্যুতে নড়েচড়ে বসেছে অথচ দ্রুতগতিতে নিহত ৪০ হাজার ফিলিস্তিনির বিষয়ে আগ্রহ হারিয় ফেলেছে। আবার তারা যখন অপহৃত ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলছে, তখন কেবল ইসরায়েলি জিম্মিদের কথাই বলছে।

পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে বিনা বিচারে আটকে রাখা হাজার হাজার ফিলিস্তিনির কী হবে? ‘অবৈধ যোদ্ধা’ আখ্যা দিয়ে আটক করা হয়েছে যাঁদের অনেককে, আর অনেকে নিরীহ শ্রমজীবী, যাঁদের সংখ্যা কেউ জানে না। অথচ তাঁদেরও পরিবার-পরিজন উদ্বিগ্ন হয়ে আছে ১০ মাস ধরে, আর জানতে পারছে না যে বন্দীরা কোথায় কীভাবে আছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। ইসরায়েল সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

গত সপ্তাহেই শিরিন ফালাহ সাব এক অসাধারণ কাজ করেছেন—গাজার ১৯ বছর বয়সী এক টিকটকারের কাহিনি তুলে ধরেছেন। মুহাম্মদ ‘মেদু’ হালিমি যখন নিজের মোবাইল ফোন চার্জ দিতে যাচ্ছিলেন, তখন নিহত হন। এই লেখাটা অন্ধকারের মধ্যে এক আলোকরেখা। গাজায় নিহত এক ফিলিস্তিনি, যাঁর নাম ও চেহারা জানা গেল। এ জন্য টিকটক ও শিরিনকে ধন্যবাদ।

মেদুর কাহিনিটা তো গলায় একটা মাংসপিণ্ড আটকে যাওয়ার মতো। আবার ইডেন ইরুশালমির যে ভিডিওটা হামাস ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটা তো কম নয়। আজকের ইসরায়েলে এ কথাগুলো বলার অনুমতি আছে কি?

  • গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া