মতামত

নদীমাতৃক দেশে নৌপথ কেন অনিরাপদ ও যাত্রী সুরক্ষাহীন?

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বজুড়ে নৌপথ ও আধুনিক নৌযান ঝুঁকিহীন নিরাপদ আনন্দভ্রমণের জনপ্রিয় যোগাযোগ ও পরিবহনমাধ্যম। রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব না দিয়ে সড়কপথে একমুখী গুরুত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশের নৌপথ এখন সবচেয়ে কম ব্যবহৃত যোগাযোগমাধ্যম। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে দেশের মোট যাত্রীর মাত্র ৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাতায়াত করেছে, ৮৮ শতাংশই সড়কপথে। প্রতীয়মান হয় যে, নৌপথে যাতায়াতের বর্তমান হার অনূর্ধ্ব ৫ শতাংশ মাত্র। এদিকে আনন্দভ্রমণের মাধ্যম হিসেবেও নৌপথ ও নৌযানের বিকাশ হয়নি বাংলাদেশে। নদীমাতৃক দেশে বিষয়টি অবাক করার মতোই!

রেলের পরই পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে সবচেয়ে কম খরচ হয় নৌপথে। বাংলাদেশে নদী ও নৌপথ জালের মতো বিস্তৃত। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশে সব নদীই নৌপথ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ ছিল। নৌপথ পরিবহন চাঁদাবাজি মুক্ত ও ইজারাদারদের দৌরাত্মমুক্ত রাখা গেলে, ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম কমে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।

নৌপথ দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও এখন বর্ষায় মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে হয়ে যায় ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার। এই হিসাবে, ছয় দশকে (১৯৬০-২০২০ সাল) দেশের নৌপথ অর্ধেক কমে গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নৌপথ আড়াই হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। মূলত উজানের ভারতীয় অংশে নদীতে বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীতে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা থাকে না, বাঁধের কারণে স্রোতহারা নদীতে পলি পতন তীব্র হয় বলে নদীগর্ভও ভরাট হয়ে গেছে। সেভাবে নেই পরিবেশ ও নৌপথবান্ধব ড্রেজিং। নাব্যতা রক্ষায় বরাদ্দকৃত ড্রেজিংয়ের কাজও চলে মানহীনভাবে, অনিয়ম তো আছেই। সরকারের পরিবহন বাজেটে নৌপরিবহন খাতের বরাদ্দ সাড়ে ছয় শতাংশ।

বাংলাদেশে খেয়াঘাট ইজারা দেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে চলাচলকারী নৌকা, ট্রলার কিংবা লঞ্চের ওপর লাইসেন্স, ফিটনেস কিংবা পরিচালনাগত কোনো মনিটরিং থাকে না, নেই তথ্যশালাও। ইজারা দেওয়া হয় বলে ঘাটের নৌযান নিবন্ধন ও তথ্যশালা তৈরি খুবই সহজ কাজ। প্রতিটি নৌযানের মেয়াদ, ইঞ্জিনের ফিটনেস, ধারণক্ষমতা নির্ধারণে নিয়মিত ও দৈবচয়নে পর্যবেক্ষণ অভিযানও খুবই সহজসাধ্য। কিন্তু আন্তরিকতাটাই নেই। অথচ সেখান থেকে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল চাঁদা ওঠায়!

দেশে সড়কপথের দৈর্ঘ্য ক্রমাগত বাড়ায় বিআইডব্লিউটিএ’র কাজের ক্ষেত্র কমছে। ফেরিঘাট, খেয়াঘাট কমেছে। অর্থনীতির সার্বিক বিকাশে বিদ্যমান ঘাটে সেবার মান বাড়ানোয় বাড়তি মনোযোগ তাই প্রত্যাশিত। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, ঘুষ-তদবিরের পর খেয়াঘাট ইজারা দেওয়া কিংবা নিবন্ধন দেওয়ার পরে তাদের দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই। নৌপরিবহনের মৌলিক নিরাপত্তা বিধান করে ও ধারণক্ষমতার ভিত্তিতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করে খাতটিকে বিকাশমান রাখা যেত।

উন্নয়নের কথিত মহাসড়কে বাংলাদেশের যে এখনো ওঠা হয়নি, তার চাক্ষুষ প্রমাণ করতোয়া নদীর নৌ দুর্ঘটনা। বারো মাসই পানি থাকে এমন বহু নদীর ওপর দরকারি যাত্রাপথে কোনো সড়ক সেতু এখনো নেই। নৌ চলাচলের প্রতিষ্ঠিত রুটে সেতুর প্রয়োজন পড়ে না সত্য, কিন্তু শুধু নদী পারাপারের জন্য যেসব খেয়াঘাটের চাহিদা বেশি, সেখানে সেতু না থাকলেও ফেরি কিংবা মানসম্পন্ন যাত্রীসেবা পৌঁছানোর বন্দোবস্ত নেই। সেতুর অভাবে, ফেরির অভাবে এসব ঘাটে নদী পারাপারে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকা বা ট্রলারই ভরসা। এসব নৌকা ও ট্রলারের চালকদের প্রশিক্ষণ নেই। যাত্রা শুরুর সময়টা অনির্ধারিত। ধারণক্ষমতার পরিমাণেও নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামও। নেই ঈদ-পূজার মতো বড় উৎসব ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিকল্পনা।  

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীর মর্মান্তিক নৌকাডুবিতে মৃত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১। এই স্থানে করতোয়া নদীর গভীরতা তেমন নয়। তবে বিলম্বিত বর্ষা ও উজানের পানির কারণে সেখানে সামান্য স্রোত ছিল। আউলিয়ার ঘাটটি একটি ইজারা দেওয়া নৌঘাট। বলা হচ্ছে, অনিবন্ধিত নৌযানের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনলে এমন দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব হবে না। এখানে দুটি প্রশ্ন করা দরকার, এক. বাংলাদেশে নিবন্ধিত নৌযানের দুর্ঘটনা কি থেমেছে, সেখানে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম রাখা হয় কি? দুই. একটি ইজারা দেওয়া নৌঘাটে নজরদারি ও যাত্রী ধারণক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না কেন?

করতোয়া নৌকাডুবির বিশ্বাসযোগ্য পর্যবেক্ষণটি হচ্ছে, অতি সাধারণ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ছোট ট্রলার নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহনই এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অপেক্ষাকৃত কম যাত্রী থাকে বলে এই নৌঘাটে একটি বা দুটি নৌকা যাত্রী পারাপার করে। ঘটনার দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনেক মানুষ এসেছিলেন। পরবর্তী খেয়ার জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে, তাই খুব ছোট নৌকায় একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষ উঠে। অদক্ষ চালক, যাত্রীদের হুড়োহুড়ি এবং অসচেতনতা এ দুর্ঘটনার বড় কারণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, সারা দেশের সব নৌরুট ও খেয়াঘাটে চলাচলকারী নৌযানের ধারণক্ষমতা ও চালকের দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ, ট্রেনিংয়ের দায়িত্বটা তো অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের। লোভের কারণে চালক বেশি যাত্রী ওঠান, এটা তো সবার জানা। কিন্তু লোভ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটা কি রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও সরকার পালন করেছে? কাজে অবহেলা তো পরের কথা, করণীয়টাই কি তারা করছে? এসবে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে কি? নাকি গরিব মারা যায় বলে এসব অবহেলাকে কার্পেটের তলায় লুকানোর পুরোনো চর্চাই চলবে! মার্চে শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যে যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে গেছে, তাতে কারও শাস্তি হয়েছে? কোস্টাল নয় কার্গো চালাচ্ছিলেন অভ্যন্তরীণ নৌপথের চালকেরা—এসব বন্ধ করে নিয়মতান্ত্রিক নৌযান নিবন্ধন, ট্রেনিং ও পরিচালনা লাইসেন্স বরাদ্দে ঠিক কী উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ?

আউলিয়ার ঘাটের স্থানীয় লোকজন বলছেন, মহালয়া উপলক্ষে প্রতিবছরই বদেশ্বরী মন্দিরে অনেক বড় অনুষ্ঠান হয় এবং আশপাশের জেলাগুলো থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীর ৫০ হাজারের মতো মানুষ অনুষ্ঠানে জমায়েত হন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ে যাত্রীর চাপ কম থাকলেও পূজা উপলক্ষে এটা একটা বড় উৎসবে রূপ নেয়। সুতরাং, এখানে বাড়তি নৌযানের দরকার ছিল এবং নদীতে স্রোত থাকায় দক্ষ চালক ও নৌকার ধারণক্ষমতা অনুসারে যাত্রী পারাপার নিশ্চিত করা দরকার ছিল। এই সচেতনতা বিআইডব্লিউটিএ কিংবা স্থানীর সরকার কারওই ছিল না।

সদরঘাট বাংলাদেশের নৌ পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহু দ্বীপ কিংবা চরে সরাসরি লঞ্চ চলে। এ ছাড়া নৌ পরিবহনের জনপ্রিয় রুট আছে মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে। সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া রুটে বড় জাহাজ চলে বলে দুর্ঘটনা কম, এটা সত্য। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা সরঞ্জাম থেকে নামকাওয়াস্তে। কয়েকটা লাইফ জ্যাকেট, বয়া দিয়েই কাজ সারা হয়। হাজারো যাত্রী পরিবহনকারী লঞ্চেও মেডিকেল সেন্টার থাকে না। আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে না, লোকদেখানো কিছু সিলিন্ডার রাখা হয়, যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। যাত্রীসংখ্যার হিসাব মানা হয় না। নৌ পরিবহনের মৌলিক নিরাপত্তার প্রতিটি বিষয় উপেক্ষিত থাকে। যাত্রী সুরক্ষার প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিএ’র কোনো দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। ঘুষের আদান-প্রদানের পর সবকিছুই এড়িয়ে যাওয়া হয়। কোনো খাতেই নিয়মিত মনিটরিং নেই, মান নিয়ন্ত্রণ নেই।

ফিটনেস ছাড়া নৌযান কত, হিসাব রাখে না কেউ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৮৬, কিন্তু ফিটনেস সনদ হালনাগাদ হয়েছে ৭ হাজার ৯০৬টির। অন্যরা কোথায় চলছে, বিআইডব্লিউটিএ জানে না। নিবন্ধিত নৌযানের সেবা ও মান দেখভালের কাজই যেখানে হচ্ছে না, সেখানে অনিবন্ধিত নৌযান নিয়ে ভাববে কে? এভাবে একটা দেশ আর কত দিন চলবে?

বাংলাদেশে খেয়াঘাট ইজারা দেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে চলাচলকারী নৌকা, ট্রলার কিংবা লঞ্চের ওপর লাইসেন্স, ফিটনেস কিংবা পরিচালনাগত কোনো মনিটরিং থাকে না, নেই তথ্যশালাও। ইজারা দেওয়া হয় বলে ঘাটের নৌযান নিবন্ধন ও তথ্যশালা তৈরি খুবই সহজ কাজ। প্রতিটি নৌযানের মেয়াদ, ইঞ্জিনের ফিটনেস, ধারণক্ষমতা নির্ধারণে নিয়মিত ও দৈবচয়নে পর্যবেক্ষণ অভিযানও খুবই সহজসাধ্য। কিন্তু আন্তরিকতাটাই নেই। অথচ সেখান থেকে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল চাঁদা ওঠায়!

ব্যক্তিমালিকানাধীন উপকূলীয় যাত্রী ও জেলে নৌযানে কীভাবে আধুনিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য আসবে তার ট্রেনিং নেই, বরাদ্দ নেই, প্রকল্প নেই। অথচ যাত্রী ও জেলে নৌযানে ডেটাবেইজ করে, লোকেশনভিত্তিক বৈরী আবহাওয়া বার্তা মুঠোফোনে খুদেবার্তায় পাঠানো যায়। নাগরিক সেবার দর্শনও নেই, আন্তরিকতাও নেই।

নৌপথ শুধু যে সস্তা ও নিরাপদ যাতায়াতের জন্যই দরকার, তা শুধু নয়। নৌপথ ঠিক থাকলে নদীর নাব্যতা ঠিক থাকে, যা সার্বিকভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ। নৌপথ হতে পারে ঝুঁকিহীন নিরাপদ আনন্দভ্রমণের জনপ্রিয় মাধ্যমও। বাংলাদেশের নদীতে নাব্যতা থাকলে, দেশের উল্লেখযোগ্য নদীতে সারা বছর পানি ও সচল নৌপথ থাকলে তা আঞ্চলিক যোগাযোগেও গুরুত্ব রাখতে পারে।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নকে সড়ক উন্নয়নের একচোখা দৃষ্টিতে না দেখে সড়ক-রেল-নৌপথের মধ্যে একটা সমন্বয় যেমন দরকার, তেমনি দরকার অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষকে একটা সক্ষম, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা এবং বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: faiz.taiyeb@gmail.com