এ দেশে দানের জিনিসের মান নিয়ে কেউ চিন্তা করেন কি? ধার্মিকেরা দানধ্যান করেন স্বর্গবাসের আশায়। চান স্বর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এক নম্বরের স্বর্গটা, কিন্তু পেতে চান সস্তা দরে। পাইকার কাপড়ের দোকানে তাই আলাদা গাঁটে থাকে জাকাতের শাড়ি বা লুঙ্গি। দানশীল ধনী ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করার জন্য সেসব গাঁটের দোকানিরা বড় বড় করে লিখে রাখেন, ‘এখানে সুলভ/ন্যায্যমূল্যে জাকাতের কাপড় বিক্রি হয়’। ধনীদের ক্রয়ক্ষমতার প্রতি এটা কোনো কটাক্ষ নয় বরং তাদের খাসলতের স্বীকৃতি। দোকানিরাও জানেন ‘দানশীল’দের মনের কথা। দানের জন্য তাঁরা কেমন ‘মাল’ খোঁজেন। বাংলায় প্রচলিত এক বাগ্ধারা আছে ‘ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া’ (কাঁড়া মানে কাঁকর বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথরকণা) অর্থাৎ ভিক্ষের চালের আবার মান বা স্ট্যান্ডার্ড কী। দিচ্ছি এই কত! সেখানে লোক দেখানোটাই মান, মালামালে মানের কোনো বালাই নেই বা থাকতে নেই।
বন্যাদুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের বিনা মূল্যে বীজ বিতরণ করা হয়েছিল। এটা নতুন কিছু নয়। প্রকৃত চাষির কাছে সঠিক পরিমাণে এটা পৌঁছায় কি না, তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা গবেষণা আর সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। পরিস্থিতির গুণগত মানে তাতে খুব একটা রকমফের হয় না। তবে এবার চাষিদের মনে একটা আশা জেগেছিল। ভেবেছিল ‘ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে হয়তো ত্রাণ বিতরকদের খাসলতে পরিবর্তন আসবে। বলার অপেক্ষা লাগে না চাষিরা এবারও হতাশ হয়েছেন। ত্রাণের বীজ গজাচ্ছে না, মাটির নিচ থেকে অঙ্কুর চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। তাই বালিয়াকান্দির (রাজবাড়ী) পেঁয়াজচাষি আমির হোসেন বললেন, ‘তিরানে বীজ ঘুমায়ে থায়ে মিভাই।’ শত দুঃখের মধ্যে রসবোধ থেকেই আমির আলীর এ এক কঠিন উচ্চারণ, যেমন তির্যক তেমনি মর্মভেদী। অবশ্য মর্ম যাঁদের, নেই তাঁদের জন্য এই মন্তব্য নস্যিমাত্র।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে উৎপাদন বাড়াতে ফরিদপুর আর রাজবাড়ীতে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রায় ৯ হাজার ২০০ চাষিকে পেঁয়াজবীজ দিয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। প্রণোদনার (ত্রাণকে এখন রগড় করে প্রণোদনা বলা হয়) এ বীজ গজানোর (জার্মিনেশন) কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফরিদপুরের দু-একটা মাঠে ২০ শতাংশ জমিতে গজালেও রাজবাড়ীর ৯৫ শতাংশই জমিতে অঙ্কুরের দেখা নেই। এ বছর রাজবাড়ীতে ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বীজ না গজানোর কারণে নির্দিষ্ট সময়ে হালি পেঁয়াজ (আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ) বাজারে আসবে না। কমপক্ষে আরও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
শুধু ফরিদপুর, রাজবাড়ী নয়; গোপালগঞ্জেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কাশিয়ানী উপজেলার রবি প্রণোদনা হিসেবে ১৪০ জন কৃষকের মধ্যে বারি-৪ ও তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করা হয়। প্রতি কেজি পেঁয়াজবীজের সঙ্গে ১০ কেজি ডিএপি, ১০ কেজি এওপি সারও দেওয়া হয়। সেখানে প্রণোদনা পাওয়া সব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছ থেকে এসব বীজ কিনে বিনা মূল্যে বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। এ জন্য বিএডিসিকে দায়ী করছে কৃষি বিভাগ।
কাশিয়ানী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঘটনার কথা স্বীকার করে সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, বিএডিসি থেকে সরবরাহ করা পেঁয়াজের বীজ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু জমিতে বপনের পর বীজ অঙ্কুরোদ্গম হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা সরেজমিনে তদন্ত করেছে। এখনো যাঁরা পেঁয়াজবীজ বপন করেননি, তাঁদের বপন করতে নিষেধ করা হয়েছে।
ভূত ঢুকেছে আলুর বীজেও। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় সরকারের দেওয়া আলুবীজ কৃষকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকেরা বলছেন, বীজ আলুর পরিবর্তে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নিম্নমানের খাবার আলু দেওয়া হয়েছে তাদের, যা রোপণযোগ্য নয়। এদিকে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় আলু প্রদর্শনীর জন্য পাঁচ চাষিকে নির্ধারণ করে উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর। ওই পাঁচ কৃষককে মোট ২০০ কেজি আলু বীজ দেওয়া হয়। সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সারও দেওয়া হয়।
চাষিদের অভিযোগ, জমি প্রস্তুতের পর বস্তা খুলে কাটা, পচা ও নিম্নমানের খাবার আলু দেখতে পান তাঁরা। আলু চাষের জন্য তাঁরা জমি তৈরি করে ফেলেছেন। এখন এসব জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষ করাও সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএডিসির আলুবীজ না পাওয়ায় জয়পুরহাট জেলা থেকে আলুর বীজ কিনে চাষিদের দেওয়া হয়েছে। চাষিরা এই আলু রোপণে অনীহা প্রকাশ করলে পরিবর্তন করে দেওয়া হবে।’
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব মৌকুড়ি গ্রামের চাষিরা এতটায় হতাশ যে তাঁরা কোনো ‘ভদ্দরলোকের’ সঙ্গে আর কোথায় বলবেন না বলে ঠিক করেছেন। একজন গালি দিয়ে বললেন, ‘সুদে টাকা নিয়েও যদি হাজার পাঁচেক টাকার বীজ কিনতাম, তা-ও ভালো ছিল। তবে সরকার আমার যে ক্ষতি করেছে, তার বিচার আমি কোথায় পাব? এখন বীজ কিনে তা বপন করেও পেঁয়াজ আবাদ হবে না।’
আস্থা হারানোর পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে
চাষিরা বলেছেন, ‘সরকারি বীজ ভালো হবে মনে করে পরীক্ষা না করেই মাঠে চারা দিয়েছি। ভবিষ্যতে আর কোনো দিন সরকারি প্রণোদনা নেব না, এবারই শিক্ষা হয়ে গেছে।’
সব শুনে মনে হচ্ছে দোষ সব চাষিদের কপালের। কৃষি বিভাগ বলছে, আমরা বিতরণ করলে কী হবে বীজ দিয়েছে বিএডিসি (কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন)। তাদের জবাব, ‘বীজ আমরা দিয়েছি তো কী হয়েছে? বীজের মান পরীক্ষা করে অন্য প্রতিষ্ঠান, তাদের জিগান।’ এই সবই চাষিদের কপালের লিখন। ভাগ্যিস, আমাদের চাষি আর খেতমজুরেরা পাঞ্জাবের চাষিদের মতো সাংগঠনিক শক্তি রাখেন না। না হলে তাঁরা এবার পৌঁছে যেত জায়গামতো।
এবারই কি প্রথম চাষিদের বোকা বানানো হলো?
না এর আগেও হয়েছে; হামেশাই হয়। যাঁরা সংসদ কাভার করেন, তাঁদের মনে থাকবে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি, (২০২৩) বীজ কেলেঙ্কারি নিয়ে এক মজার আলোচনা হয়েছিল। সে বছরও নিম্নমানের বীজ সরবরাহের কারণে ৮০ শতাংশ পেঁয়াজবীজে চারা গজায়নি। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসার পর কমিটি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কমিটির কাছে আসা অভিযোগে বলা হয়েছিল, সম্প্রতি সরকার বিনা মূল্যে কৃষকদের মধ্যে পেঁয়াজবীজ সরবরাহ করেছে। এ বীজ ‘সততা বীজ ভান্ডার’ ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করে সরকারকে সরবরাহ করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গরমকালের বীজের পরিবর্তে শীতকালীন নিম্নমানের বীজ সরবরাহের কারণে ৮০ শতাংশ বীজে চারা হয়নি। বীজ কেনার ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব এবং বিএডিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। বলা বাহুল্য, উৎস জানার পর এটা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হয়নি। সংসদীয় কমিটি জেনেছিলে, বিএডিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা সরকারকে নাকি ভুল বুঝিয়ে উন্নতমানের বীজ না কিনে ভারতের নিম্নমানের বীজ কিনে প্রণোদনা হিসেবে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করেছে। জানতে ইচ্ছা করে সেই কর্মকর্তারা এখন কোথায় ও কেমন আছেন?
গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) কৃষি মন্ত্রণালয়ে কৃষি উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এক সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজচাষিদের পুনরায় বীজ সরবরাহ করা হবে। কৃষিসচিব জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ সেই সভায় সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক, উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসির কর্মকর্তারা অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।
থুক্কু মার্কা এই দরদি সিদ্ধান্ত মন্দের ভালো। কিন্তু শুধু দরদ দেখালে হবে না, যাঁদের জন্য চাষিদের এই পেরেশানি, তাঁদের দায়ের দায়িত্বটাও আমলে নিতে হবে। না হলে গণ-অভ্যুত্থান আর আবু সাঈদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।
● গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক
wahragawher@gmail.com