বার্তা আদান-প্রদান অ্যাপে আপনার গোপনীয়তা কতটা সুরক্ষিত

মার্কিন সিরিয়াল কিলার ডেনিস রেডার ২০০৫ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিন দশক ধরে কমপক্ষে ১০ জনকে হত্যা করেছিল। শুরুটা হয় ১৯৭৪ সালে কানসাসের একটি বাড়িতে দুই শিশুসহ পরিবারের চার সদস্যকে শ্বাস রোধে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। ২০০৪ সালে রেডারের প্রথম খুনের ৩০তম বার্ষিকীতে স্থানীয় এক পত্রিকা ফিচার ছাপিয়ে জানায়, ‘এই হত্যাকারী ইতিমধ্যে হয়তো মারা গেছে অথবা কারারুদ্ধ হয়েছে।’ 

তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ডেনিস তার হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পাঠাতে শুরু করে। নড়েচড়ে বসে শহরবাসী, তৎপর হয় পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশের কাছে ফ্লপি ডিস্কে করে কিছু প্রমাণ পাঠাতে চাইলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্লপি ডিস্কে রেডারকে তথ্য পাঠানোর জন্য বলে পুলিশ। অতঃপর ১ দশমিক ৪৪ মেগাবাইটের বেগুনি রঙের এক ফ্লপি ডিস্ক পাঠায় রেডার।

ডিস্কের ভেতর থেকে রিকভারি সফটওয়্যার দিয়ে মুছে ফেলা একটি ডকুমেন্ট খুঁজে পায় পুলিশ। সংগ্রহ করে সেই ডকুমেন্টের ‘মেটাডেটা’। ফাইলের ভেতরকার মূল ডেটা, অর্থাৎ লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি আমরা দেখতে পারি। কিন্তু সেই মূল ডেটা ছাড়া আরও বেশ কিছু তথ্য ফাইলের ভেতর লুকানো থাকে। যেমন ফাইলটি কখন সৃষ্টি বা হালনাগাদ করা হয়েছে, কোন ব্যবহারকারী সেটি তৈরি করেছে ইত্যাদি। মূল ডেটা-সম্পর্কিত এসব তথ্যই মেটাডেটা।

ডিস্কের সেই ডকুমেন্টের মেটাডেটায় হালনাগাদকারী হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায় ডেনিসের নাম, সঙ্গে পাওয়া যায় কর্মস্থলের নামও। একের পর এক তথ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত করে অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয় ডেনিস রেডারকে। টানা ১০ বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রেডারকে বর্তমানে রাখা হয়েছে কানসাসের এল ডোরেডো কারাগারে।

বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া মেটাডেটা জোড়া লাগিয়ে কী করা যেতে পারে, সেটির উদাহরণ হিসেবে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সনদ জারি ব্যাহত করার প্রয়াসে ৩৬ ঘণ্টায় ৫ জন নিহত হওয়ার সেই ক্যাপিটল হামলার কথাই ধরা যাক।

বিক্ষোভকারীরা ক্যাপিটলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উইল ভোগেল নামের একজন স্ন্যাপচ্যাটে দুটি ভিডিও পোস্ট করেন। এফবিআই ফেসবুকে অনুসন্ধান করে তাঁর অ্যাকাউন্ট খুঁজে পায় এবং অনুসন্ধান পরোয়ানা জারি করে ফেসবুকের কাছ থেকে ভোগেলের ই-মেইল, ফোন নম্বরসহ আরও তথ্য সংগ্রহ করে।

বিস্তারিত তথ্যগুলো নিয়ে গাড়ির ডেটাবেজ চেক করে দেখা যায়, উইল ভোগেলের নামে নিউইয়র্কের নম্বর–প্লেটযুক্ত একটি গাড়ি আছে। লাইসেন্স প্লেট রিকগনিশন সিস্টেমে সেই নম্বর দিলে বেরিয়ে আসে উইল ভোগেলের গাড়িটি ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের কাছেই রাখা ছিল। সরাসরি কোনো প্রমাণ না থাকলেও এভাবে বিভিন্ন ধরনের মেটাডেটা একত্র করে ক্যাপিটল গ্রাউন্ডে সহিংস প্রবেশের জন্য উইল ভোগেলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে এফবিআই।

তবে এই মেটাডেটা যেমন অপরাধ প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব, তেমনি আবার সম্ভব অপরাধ করার জন্যও। গোপনীয়তা লঙ্ঘন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইবার অপরাধ সংঘটনের মাধ্যম হতে পারে মেটাডেটা। বহুল ব্যবহৃত বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপগুলো থেকে উপযুক্তটি নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও এই মেটাডেটা সুরক্ষিত থাকার প্রশ্ন চলে আসে।

জনপ্রিয়তার বিচারে যোগাযোগ পরিষেবাগুলোর মধ্যে দুই বিলিয়ন ব্যবহারকারী নিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ (সূত্র: স্ট্যাটিস্টা)। এরপর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ব্যবহারকারী চীনকেন্দ্রিক উইচ্যাট এবং ১ বিলিয়ন ব্যবহারকারীর ফেসবুক মেসেঞ্জার। এ ছাড়া আছে টেলিগ্রাম (৯০০ মিলিয়ন) ও স্ন্যাপচ্যাটের (৮০০ মিলিয়ন) মতো অ্যাপগুলো। আবার গোপনীয়তার বিচারে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় সিগন্যাল প্রাইভেট মেসেঞ্জারকে হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেলিগ্রামের থেকেও এগিয়ে রাখেন অনেকে (সূত্র: পিসি ম্যাগাজিন) 

প্রায় সব কটি অ্যাপেই অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড এনক্রিপশন সুবিধা আছে, অর্থাৎ প্রেরকের ডিভাইসে এনক্রিপ্ট করা বার্তাগুলো শুধু প্রাপকের ডিভাইসে ডিক্রিপ্ট করে পড়া বা দেখা যাবে, মধ্যখানে কেউ বার্তা দেখতে বা পড়তে পারবে না। কিন্তু গোপনীয়তার মানদণ্ডে আরেক বিবেচ্য বিষয় হলো মেটাডেটার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা। উল্লেখ্য, ডেটা সংরক্ষণ করা থাকলে সেটি আইনি, ব্যবসায়িক বা অন্য যেকোনো কারণে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে শেয়ার করার সুযোগ থাকছে। সংরক্ষিত না থাকলে, শেয়ার করার সুযোগই নেই।

হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের মধ্যে তুলনা করা যাক। হোয়াটসঅ্যাপ গোপনীয়তা নীতিতে গেলে দেখা যায়, ব্যবহারকারী কার সঙ্গে যোগাযোগ করল, কতক্ষণ করল, কতবার করল, কী ডিভাইস ব্যবহার করল ইত্যাদি স্পর্শকাতর তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে আইপিসহ নানান মেটাডেটা সংরক্ষণ করে হোয়াটসঅ্যাপ। 

অপর দিকে সিগন্যাল ফোন নম্বর ও গুটিকয় অত্যাবশ্যকীয় ডেটা ছাড়া অতিরিক্ত ডেটা সংগ্রহ করে না বলেই দাবি করা হয়। সিগন্যালের তথ্য অনুযায়ী, অলাভজনক পরিষেবাটি ডিজাইনই করা হয়েছে কোনো স্পর্শকাতর ডেটা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সিগন্যালে মেটাডেটা গোপন রাখার অপশনও আছে।

এরপরও বিশ্বব্যাপী হোয়াটসঅ্যাপ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ ইতিমধ্যে বিশালসংখ্যক ব্যবহারকারী এটির সঙ্গে সুপরিচিত। এটি ব্যবহারবান্ধব, সহজেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়, এর বেশ কিছু ফিচার আছে, যা অন্যগুলোতে নেই। অপর দিকে সিগন্যাল ছাড়াও বেশ কিছু পরিষেবা রয়েছে, যেগুলো নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাকে মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়েছে।

অন্যদিকে ফেসবুক মেসেঞ্জারের মূল লক্ষ্যই হলো ফেসবুক পরিষেবার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। হোয়াটসঅ্যাপ বা সিগন্যালের তুলনায় নিরাপত্তা বা গোপনীয়তার দিকে এটির নজর অপেক্ষাকৃত কম।

অতএব কোন যোগাযোগ মাধ্যম কার জন্য বেশি উপযোগী, সেটি নির্ভর করবে ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্য ও পছন্দের ওপর। গোপনীয়তার গুরুত্ব কার কাছে কতটুকু, সেটি একান্তই ব্যবহারকারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত।

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

bmmainul@du.ac.bd