তাহলে সংঘাতেই ‘মুক্তি’ খুঁজছেন তাঁরা! 

এ রকম অদ্ভুত ঘটনা আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে কমই ঘটেছে। আওয়ামী লীগ যা চায়, বিএনপিও তা-ই চেয়েছে। সম্ভবত এবারই প্রথম ঘটল। আওয়ামী লীগ বলল, বিএনপির সঙ্গে বসব না। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিও জানিয়ে দিল, তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসবে না।

নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ বা আলোচনা হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলে আসছিল বহুদিন থেকেই। দুই দলেরই মাঝারি পর্যায়ের নেতারা এত দিন জোর গলায় বলেছিলেন, কিসের আলোচনা? সবকিছু রাজপথে ফয়সালা হবে।

তারপরও দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলেন, দুই দলের নেতাদের সুমতি হোক। কথাবার্তা চলুক। কিন্তু টিভি টক শো ছাড়া তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। তা-ও পর্দায় তাঁরা যা বলেন, বাইরে এসে ভিন্ন কথা বলেন। মাঝেমধ্যে প্রতিপক্ষকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে দলে থাকতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। কিছু মনে করবেন না। এসব নেতার বক্তৃতা-বিবৃতির লক্ষ্য দর্শক-শ্রোতা নন; দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

যখন বিএনপির সাত সংসদ সদস্য সংসদে ছিলেন, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়—সরকারি দলের নেতাদের তাঁদের কথা শুনতে হতো। মন্ত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। বিএনপির দুজন সংসদ সদস্যকে সামাল দিতে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাকে গলদঘর্ম হতে দেখেছি। কিন্তু ওই সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করার পর মন্ত্রীরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। এখন আর প্রশ্ন করার কেউ নেই। সর্বত্র স্তুতি-বন্দনার প্রতিযোগিতা।

এখন সরকারকে সংসদের ভেতরে-বাইরে কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। অফিশিয়াল বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে গলার আওয়াজ বাড়ানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু মামলার ভয়ে সেই আওয়াজ আবার ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। মামলা করার কারণে কয়েক মাস দলের চেয়ারম্যানকে পর্যন্ত ‘নির্বাক’ থাকতে হয়েছে। ‘নির্বাক’ থাকার চেয়ে নিম্নকণ্ঠ হওয়া ভালো। আর আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীরা সংসদে কিছু না বললেও ১৪ দলের বৈঠকে দর-কষাকষি করে আসনসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রথম আলোর খবরে দেখলাম, ইসলামপন্থী কিছু দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে ঢোকার চেষ্টা করছে। এতে তাদের ধর্ম রক্ষা না হলেও আর্থিক তরক্কি হবে। রাজনীতি এখন নীতি–আদর্শের চেয়ে আর্থিক তরক্কির উৎকৃষ্ট উপায়।

বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজারের আগুন জনজীবনে তাপ ছড়াচ্ছে। তার ওপর নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি একবার ভেবে দেখেছেন? সরকারি দলের নেতারা মুখে বলছেন তাঁদের ওপর বিদেশিদের চাপ নেই। কিন্তু তাঁদের ভাষাভঙ্গিতে কিন্তু সেটা প্রমাণিত হয় না। তঁারা জনসভায় দলীয় কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে ‘গরম-গরম’ কথা বলেন। আর বিদেশিদের সঙ্গে যখন বৈঠক করেন, তখন সুর অনেকটা নরম হয়ে যায়। এ স্ববিরোধিতা থেকে রাজনীতি কবে বেরিয়ে আসবে?

সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল একাধিকবার বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট, সেটি রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সমাধান করতে হবে। এর মাধ্যমে তিনিও সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সমস্যা হলো কোনো দল যদি রাজনৈতিক সংকটই স্বীকার না করে, তাহলে সমাধান আসবে কীভাবে? ক্ষমতাসীন দলের দাবি, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কোনো দল নির্বাচন করতে চাইলে করবে আর কোনো দল করতে না চাইলে করবে না; এ নিয়ে অনুরোধ-উপরোধ করার কিছু নেই। তারা খুবই খাঁটি কথা বলেছে। কিন্তু তাদের এসব কথা কি বিএনপির আমলেও সত্য ছিল না? সে সময় তো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রায় সব বিরোধী দল আন্দোলন করে বিএনপি সরকারকে সংবিধান পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল।

তখন কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে ছিল না। তারা একই দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। যেমন বিএনপির সঙ্গে এখন ২০–দলীয় জোট, ৭–দলীয় জোট, ১২–দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। নির্বাচন নিয়ে এত হানাহানি, মারামারি, লাঠালাঠি পৃথিবীর আর কটা দেশে আছে? আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করি, বিজয়ী হই; কিন্তু গণতন্ত্র চর্চা করতে জানি না।

নির্বাচনী সংকট কাটাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব একবার সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম করল, আরেকবার সেই ব্যবস্থা বাতিল করল, কিন্তু নির্বাচনী সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। কেন ৫১ বছর ধরেই নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক করতে হচ্ছে? কেন পালা করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে, কেন ক্ষমতার আসন থেকে বারবার বিদেশিদের আশ্বস্ত করতে হচ্ছে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে। এত কিছুর পরও কেন আমরা দো–আঁশলা গণতন্ত্রের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম না।

সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, এ কথা ঠিক। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া তো গণতন্ত্রের কথা চিন্তাও করা যায় না। নির্বাচন নিয়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতারা যেসব কথা বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তাঁরাও একই কথা বলতেন। আবার এখন বিএনপির নেতারা যা বলছেন, বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ নেতারাও তা-ই বলতেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসন ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে দেন। কিন্তু গণতন্ত্র এমন নয় যে আওয়ামী লীগ আমলে এর এক রকম সংজ্ঞা হবে, বিএনপির আমলে অন্য রকম।

নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকট কাটাতে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন কি না, সাংবাদিকদের এ রকম প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ মার্চ বলেছেন, ‘সংলাপ কার সঙ্গে করব? ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংলাপ করেছি, তাতে রেজাল্ট কী? নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি।’ এরপর তিনি অতীতের কিছু রাজনৈতিক ঘটনা ও তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘...এত কিছুর পরও তাদের সঙ্গে আবার কিসের বৈঠক?’

পরদিন প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা তো তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) সঙ্গে কোনো সংলাপ করব না। তাঁর সঙ্গে ডায়ালগ করব কেন? তিনি তো কথাই রাখেন না।’

এই প্রথম আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কোনো বিষয়ে একমত হতে দেখলাম। কেউ কারও সঙ্গে সংলাপে বসতে চায় না। দুই পক্ষ যে যার অবস্থানে অনড়। তাহলে নির্বাচনটি কীভাবে হবে? মির্জা ফখরুল কিন্তু সংলাপে না যাওয়ার মধ্যে সীমিত থাকেননি। তিনি আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধের কথাও বলেছেন। এই প্রতিরোধের অর্থ কি আবার হরতাল, আবার অবরোধ! আবার সংঘাত, গায়ের জোর! আওয়ামী লীগ চাইবে তার মতো করে নির্বাচন করতে। বিএনপি চাইবে সেই নির্বাচন ঠেকাতে। সে ক্ষেত্রে সংঘাত অনিবার্য।

বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজারের আগুন জনজীবনে তাপ ছড়াচ্ছে। তার ওপর নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি একবার ভেবে দেখেছেন? সরকারি দলের নেতারা মুখে বলছেন তাঁদের ওপর বিদেশিদের চাপ নেই। কিন্তু তাঁদের ভাষাভঙ্গিতে কিন্তু সেটা প্রমাণিত হয় না। তঁারা জনসভায় দলীয় কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে ‘গরম-গরম’ কথা বলেন। আর বিদেশিদের সঙ্গে যখন বৈঠক করেন, তখন সুর অনেকটা নরম হয়ে যায়। এ স্ববিরোধিতা থেকে রাজনীতি কবে বেরিয়ে আসবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com