উন্নয়ন সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনায় অমর্ত্য সেন সব সময় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয় দুটি উল্লেখ করেন। একটি গরিব দেশের বা রাজ্যের পক্ষেও যে শিক্ষার হারের এমন উল্লম্ফন সম্ভব, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি সব সময় শ্রীলঙ্কার ও ভারতের কেরালার উদাহরণ টানেন। তিনি যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমর্থন করেন না, তার কারণ এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্র তার জনগণের শিক্ষার ও স্বাস্থ্যের পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করে না।
তিনি সামগ্রিক মানব উন্নয়নের জন্য ব্যক্তির ক্ষমতার বিকাশে বিশ্বাস করেন। মানব উন্নয়নে তাঁর ‘ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ’ তথা ‘ব্যক্তির আত্মশক্তি উৎসারণের নীতি’-তে প্রফেসর সেন শিক্ষার দুটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন, যা ব্যক্তির সক্ষমতা বিকাশে সহায়ক। তাদের মধ্যে একটি হলো সক্ষমতা এবং সুযোগ বৃদ্ধি। অন্যটি একটি উচ্চ মার্গের দার্শনিক তত্ত্ব, যা এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা অসম্ভব।
‘সক্ষমতা ও সুযোগ বৃদ্ধি’ কথাটির অনেক গভীর একটি অর্থ আছে। ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’ মানে মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে বিদ্যমান সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো। যদি ব্যক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে তারা, শুধু একটি নতুন চাকরি খুঁজে পাওয়া নয়, বরং যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করবে। ব্যক্তির সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার সুযোগ তৈরি ইত্যাদির মতো প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও রাষ্ট্রের ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা জানান অমর্ত্য সেন। বলেন, রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সম্পদকে সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজে লাগাতে হবে। তারপর আসে সুযোগ বিতরণের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন। বণ্টন যত বেশি সুষম হবে, সমাজের দ্বারা অর্জিত নিট লাভ তত বেশি হবে। সুযোগগুলো মেরুকরণ হলে নিট লাভ হবে তত কম।
বণ্টন সুষম হলে প্রতিটি ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে আরও বেশি সক্ষম হবে, যা তাঁর সামগ্রিক বৃদ্ধিতে এবং বিকাশে অবদান রাখবে। এই ব্যবস্থা থেকে যে সুফল আসবে, তা সমাজের প্রতিটি সদস্য ভোগ করবে। এর মানে হলো উন্নয়ন যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, উন্নয়নের স্তর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাবে না।
স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রফেসর সেন বলেন, জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতিকে সমগ্র উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে সর্বজনীনভাবে। সেন যুক্তি দেখান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাধারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকে উন্নীত করা যেতে পারে, তবে স্বাস্থ্যের অগ্রগতিকে একটি পৃথক লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা দরকার।
রাষ্ট্রকে অবশ্যই এটিকে একটি অগ্রাধিকার করণীয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শুধু তা–ই নয়, স্বাস্থ্য খাত ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে সমতার নীতি প্রতিফলিত হতে হবে। তিনি পরিষ্কার বলেন, স্বাস্থ্যের উন্নতি সামাজিক-মানবিক উন্নয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মতে, সুস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি একে অপরকে এগিয়ে নেয়। প্রফেসর সেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটায়—এটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান, কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা এই সাধারণ স্বতঃসিদ্ধকে উপেক্ষা করে আসছেন বছরের পর বছর, যা বিস্ময়েরও অতীত। অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন তত্ত্বের আলোকে জাতিসংঘও ক্রমাগত এই স্বতঃসিদ্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছে। বলছে, শিক্ষা ঊর্ধ্বমুখী আর্থসামাজিক গতিশীলতা সৃষ্টি করে, শিক্ষা দারিদ্র্য থেকে মুক্তির চাবিকাঠি। এর জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা।
শিক্ষাবৈষম্য কমাতে এবং লিঙ্গ সমতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে, যা ‘সকলের জন্য উন্নয়ন’-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সংস্থাগুলো আরও বলছে, একটি ভালো মানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণের ভিত্তি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন—এই প্রপঞ্চগুলোর মধ্যে একাধিক কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধে শিক্ষার প্রয়োজন। একই সঙ্গে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের পড়াশোনা করার জন্যও তাদের হৃষ্টপুষ্ট এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া জরুরি।
শিক্ষা প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সৃষ্টি করে। এটি উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবেও কাজ করে। প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের মধ্যে যে একটি দ্বিমুখী কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে, তা অনেকটা স্বতঃসিদ্ধের মতো।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ ওয়াল্ট রস্টো (১৯১৬-২০০৩) তাঁর ‘মর্ডানাজেশন থিওরি’-তে তথা ‘আধুনিকীকরণ তত্ত্বে’ বলেন, জগতের ও জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মানব উন্নয়নের জন্য নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যে নাগরিকেরা পরকালের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনে বেশি শ্রম দেবেন না।
একজন অর্থনীতিবিদ উন্নয়নের ইতিহাস থেকে উপাত্ত পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে আসেন। একই কাজ করেছেন প্রফেসর সেনও। ইউরোপের, যুক্তরাষ্ট্রের, জাপানের, রাশিয়ার উন্নয়নের ইতিহাস—সবই একই গল্প প্রকাশ করে। আর তা হলো সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করা।
এমনকি বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালের পর থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের ফলেই মানবিক-সামাজিক উন্নয়ন সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিবাচক লক্ষণ দেখাতে শুরু করেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার অগ্রগতি, নিম্ন গর্ভনিরোধের হার, জন্মহার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা হ্রাস, শিশু টিকাদানে সাফল্য, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নের মধ্যে দ্বিমুখী কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। ফলে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি উচ্চতর উন্নয়নের জন্ম দেয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার গড় থেকে অনেক কম—এমনকি আফগানিস্তানের এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর গড় থেকেও কম। বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জিডিপির ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করেছে যেখানে আফগানিস্তান করেছে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ভুটান ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর গড় ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ভুটান শিক্ষার ওপর তার বরাদ্দ বাড়াতে থাকে এবং ২০২৩ সালে এই বরাদ্দ ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ-এ পৌঁছেছিল যখন বাংলাদেশ এটি হ্রাস করতে থাকে—২০১৭ সালে একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পরেও।
২০১৭ সালে সর্বাধিক ২ দশমিক ২২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। একই অবস্থা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও—এই খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ দক্ষিণ এশীয় এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর গড়ের নিচে, এমনকি আফগানিস্তানেরও নিচে। সব উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষজ্ঞ—সবার পরামর্শ সত্ত্বেও, সরকার ২০২৪-২৫ বাজেটেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নিম্ন বরাদ্দের প্রবণতাটি বজায় রেখেছে। অথচ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হলো হিউম্যান ক্যাপিটালের তথা মানবসম্পদের ভিত্তি।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ ওয়াল্ট রস্টো (১৯১৬-২০০৩) তাঁর ‘মর্ডানাজেশন থিওরি’-তে তথা ‘আধুনিকীকরণ তত্ত্বে’ বলেন, জগতের ও জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মানব উন্নয়নের জন্য নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যে নাগরিকেরা পরকালের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনে বেশি শ্রম দেবেন না।
রষ্টোর মতো অমর্ত্য সেনও জগতের ও জীবনের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির মতো সাংস্কৃতিক উপাদান জীবনমান উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ গ্রন্থে প্রফেসর সেন মত প্রকাশ করেন, মানব উন্নয়ন সর্বাধিক করার জন্য জনগণকে সব ধরনের পূর্বধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের ধরন ও শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্র দেখে মনে হয় না, স্বাধীন, মুক্তবুদ্ধি মানুষ গড়ার কোনো আয়োজন বাংলাদেশে আছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ও নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়টি বোঝেন বলেও প্রতীয়মান হয় না।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com