আগস্ট আমাদের শোকের মাস। ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। এটা অভূতপূর্ব, অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিয়োগান্ত। আমরা আগে ছিলাম পাকিস্তানি। এখন বাংলাদেশি। আমাদের পাকিস্তানবিরোধী রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে আছে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও দ্রোহ। পাকিস্তানে নিয়মিত বিরতিতে জারি হয় কোটালের রাজ। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশেও এ রকম দেখেছি তিনবার। ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালে। এই সব কটির মধ্যে ব্যতিক্রম হলো ১৯৭৫। অন্য সব অভ্যুত্থান ছিল ‘রক্তপাতহীন’। ১৯৭৫ ছিল রক্তাক্ত। কেন এমন হলো?
১৫ আগস্ট রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে গিয়েছিল। এই পালাবদলের দুটি উপাদান আছে। একটি হলো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন। পরিবর্তন করতে গিয়ে সরকারপ্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা খুন হন। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা আর চিলির সালভাদর আয়েন্দের কথা আমরা জানি। এটা আকছার হচ্ছে নানা দেশে। কিন্তু দ্বিতীয় উপাদানটি ব্যতিক্রমী। খুব কম দেশেই এ রকম হয়। আমাদের দেশে শুধু সরকারপ্রধান বা তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীরা নন, খুন হয়েছেন নারী-শিশুসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। এখানে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এই দ্বিতীয় উপাদানটি সচরাচর দেখা যায় না। এমনটি হয়েছিল রুশ বিপ্লবের সময় আর ইরাকে সামরিক চক্রের ক্ষমতা দখলের সময়। পরিবারের কাউকে আর জীবিত রাখেনি বিপ্লবীরা বা অভ্যুত্থানকারীরা। বাংলাদেশে সহিংসতার মাত্রা এত ছিল যে হত্যাকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য জারি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। অবশ্য এ থেকেও আমরা শিখি না। এর আগে-পরে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে রক্ষী বাহিনীকে, অপারেশন ক্লিন হার্টে। র্যাবের কথাও শুনি। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই।
১৫ আগস্ট নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হচ্ছে। আরও হবে। ৪৭ বছর হয়ে গেল। অনেক কিছুই জানা গেল না। বলা হয়ে থাকে, এটা শুধু ‘কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার’ কাজ নয়, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। সেই ষড়যন্ত্রটি আজও উন্মোচন করা গেল না। এ নিয়ে একটি কমিশন গঠনের কথা আজকাল বেশ জোরেশোরেই শোনা যায়। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব আমিও দিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে। আমি এমনও বলেছি, যেকোনো কারণেই হোক, সরকার প্যান্ডোরার বাক্সের ডালা খুলতে চায় না। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে নাম ধরে ধরে ষড়যন্ত্রকারীর পরিচয় জানানো হচ্ছে। এটা যদি জানাই থাকে, তাহলে কমিশন বানিয়ে লাভ কী? একটা শ্বেতপত্র–জাতীয় কিছু দিয়ে দিলেই হয়।
১৫ আগস্ট নিয়ে হাতের কাছে আছে দুটি বই, লরেন্স লিফশুলৎজের দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন আর অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড। দুটো বইকে অভ্রান্ত ধরে নিয়ে মন্তব্য করতে থাকলে তো আর অনুসন্ধানের দরকার পড়ে না। ১৫ আগস্ট ও তার পরপর আমরা দেখেছি কয়েকজন মেজর-ক্যাপ্টেন বঙ্গভবনে বসে ছড়ি ঘোরাত। তাদের নেতা ছিলেন রশিদ আর ফারুক। মসনদে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হন জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। তাঁর নিচেই ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। এটা অনুমিতই ছিল যে মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে নতুন একজনকে সেনাপ্রধান করা হবে। এটি করতে ৯ দিন লেগে গেল। সেনাপ্রধান হিসেবে মোশতাক, ওসমানী, রশিদ ও ফারুকের প্রথম পছন্দ ছিলেন খালেদ মোশাররফ। ওসমানী জিয়াউর রহমানকে খুব অপছন্দ করতেন। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীদের বেশির ভাগের পছন্দ হিসেবে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তো দুগ্ধপোষ্য শিশু নন। তিনি জানতেন, তাঁকে সরে যেতে হবে। তিনি কেন ১৫ আগস্টের পরপর পদত্যাগ করলেন না। তাহলে তো তিনি বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতেন। তাঁর কি একটি চাকরির এতই দরকার ছিল?
এ রকম একটি কমিশন যদি সত্যি সত্যিই আলোর মুখ দেখে, তাহলে তাদের প্রাথমিক কাজ হবে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যাঁরা জীবিত, তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া, ১৫ আগস্টের পরের ঘণ্টা ও দিনগুলোতে তাঁরা কোথায় ছিলেন, কী করেছেন। আমরা জানি, আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয় ২৩ আগস্ট। তাহলে মাঝের এই সাত দিন তাঁদের কী ভূমিকা ছিল। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। ঘর থেকেই শুরু হোক অনুসন্ধান। ইতিহাসের প্রতি ন্যায়বিচারের স্বার্থে সত্যটা বের করা জরুরি।
১৫ আগস্ট সকালেই তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআরপ্রধান, পুলিশপ্রধান, রক্ষী বাহিনীর উপপ্রধান (প্রধান তখন দেশে ছিলেন না) ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে মোশতাকের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে বিবৃতি পাঠ করেন। পরে আমরা দেখেছি, তাঁদের অনেকেই পুরস্কার পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ ওসমানীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। সফিউল্লাহ ও খলিলুর রহমান সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এ কে খন্দকার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। কী করে এটা সম্ভব? দেশে কি মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার লোকের আকাল পড়েছিল? ৩০টি ট্যাংক কুর্মিটোলা থেকে রওনা দিয়ে শহরে ঢুকল। ৩০টি ট্যাংক একসঙ্গে চললে যে প্রচণ্ড শব্দ হয়, তাতে তো সেনানিবাসে কারও পক্ষে ঘুমানো সম্ভব নয়! অথচ কাকপক্ষীও টের পেল না! তখন সেই ট্যাংকে গোলাও ছিল না। পরে খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধানের অনুমতি না নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ট্যাংকে গোলা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।
এবার আসি অভ্যুত্থান সম্পর্কে। চর্মচক্ষে দেখেছি, বাকশাল-আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গভবন আলোকিত করে রাখলেন। মন্ত্রিসভায় সবাই যঁার যঁার পুরোনো মন্ত্রণালয় পেলেন। দেখেশুনে মনে হয়, আওয়ামী লীগের একটি অংশকে হটিয়ে আরেকটি অংশ সরকারের দখল নিল। একটা বিষয় পরিষ্কার। ষড়যন্ত্র হয় ঘরের ভেতরে। বাইরে থেকে সুযোগসন্ধানীরা তখন ঢুকে পড়ে। ষড়যন্ত্রের শর্ত তৈরি না হলে তার ওপর সওয়ার হয়ে কেউ অঘটন ঘটাতে পারে না। আওয়ামী লীগকে খুঁজে দেখতে হবে, কী করে দলে ও সরকারের মধ্যে শর্তগুলো তৈরি হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, দলে এত নেতা, তারপরও তাঁর বাবার লাশ ৩২ নম্বরে পড়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বেতনভোগী লোকজন ছিলেন। তখন যাঁরা গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগের হর্তাকর্তা, তাঁরা কি কখনো লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন যে এই বাড়িটি রাষ্ট্রপতির জন্য নিরাপদ নয়? আমি এই প্রতিবেদনের কপি দেখতে ইচ্ছুক। থাকলে তা আর্কাইভে থাকবে। না হলে বলব, তঁারা এ ধরনের কোনো রিপোর্ট দেননি। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’–এর প্রধান আর এন কাও নিজে ঢাকা এসে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাব্য অভু্যত্থানের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। আমাদের কর্মকর্তারা কী করেছেন? তাঁরা কর্তব্যে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন। এখন তঁারা শূন্যে আঙুল উঁচিয়ে একে–ওকে বলছেন ষড়যন্ত্রকারী।
কমিশন হলেই যে আমরা সবকিছু জানতে পারব, তার নিশ্চয়তা নেই। দেশে তো অনেক কমিশন আছে। তাঁরা কে কী করছেন, তা আমরা দেখি। তাঁদের প্রতি কার কতটুকু আস্থা? নতুন আরেকটি কমিশন হলে তা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে? অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, কমিশন সে রকমই কাজ করে বা প্রতিবেদন দেয়, যা দেখলে সরকার খুশি হয়। আমার মনে হয়, কোনো রাজনৈতিক সরকারের আমলেই এ রকম একটি কমিশনের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন হবে। বেসরকারি উদ্যোগে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ রকম একটি অনুসন্ধান চালানো সম্ভব, যদি সরকারি সংস্থাগুলো সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেয়। সে জন্য দরকার হবে গোয়েন্দা তথ্যের। তবে সেগুলো অবমুক্ত করা হবে কি না তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে।
আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো তো অনেক তথ্য ক্লাসিফায়েড সিল দিয়ে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনিস-উজ-জামান খানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘তদন্তের স্বার্থে এ কমিটি কয়েকটি সংস্থার প্রধান ও কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা আবশ্যক বলে মনে করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবে এ কাজগুলো করা সম্ভব হয়নি।’ ১৫ আগস্ট নিয়ে কোনো কমিশন গঠন করা হলে তারাও একই সমস্যায় পড়তে পারে।
এ রকম একটি কমিশন যদি সত্যি সত্যিই আলোর মুখ দেখে, তাহলে তাদের প্রাথমিক কাজ হবে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যাঁরা জীবিত, তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া, ১৫ আগস্টের পরের ঘণ্টা ও দিনগুলোতে তাঁরা কোথায় ছিলেন, কী করেছেন। আমরা জানি, আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয় ২৩ আগস্ট। তাহলে মাঝের এই সাত দিন তাঁদের কী ভূমিকা ছিল। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। ঘর থেকেই শুরু হোক অনুসন্ধান। ইতিহাসের প্রতি ন্যায়বিচারের স্বার্থে সত্যটা বের করা জরুরি।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক