মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে গেলে কখনো কখনো অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এই সহযোগিতার একটি পর্যায় হলো ঋণের আদান–প্রদান। ঋণ মূলত আমানত। আমানত রক্ষায় কোরআনে নির্দেশনা রয়েছে। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানত তার প্রাপককে দিয়ে দাও।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৫৮)।
ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোরআন কারিমে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন যেন মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন ও ওসিয়ত পালনের পূর্বেই তাঁর ঋণ পরিশোধ করা হয়। (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১১-১৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের জানাজা নামাজ পড়াতেন না, যদি তাঁর ঋণ অপরিশোধিত থাকত। (বুখারি: ২১৪৮) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অহংকার, গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ—এই তিন বিষয় থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজি: ১৫৭২; ইবনে মাজাহ: ২৪১২)
হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে।’
‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম লোক, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে।’ (বুখারি: ২২৩২) ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম: ৪৭৭৭) ‘মুমিন ব্যক্তির রুহ তাঁর ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তাঁর পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪১৩; তিরমিজি: ১০৭৮-১০৭৯)
মুহাম্মদ ইবনে জাহাস (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় তিনি আকাশের দিকে তাঁর মাথা ওঠান, তারপর তাঁর হাত ললাটের ওপর স্থাপন করে বলেন, “সুবাহান আল্লাহ! কী কঠোরতা অবতীর্ণ হলো!” আমরা ভয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। পরদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! ওই কঠোরতা কী ছিল, যা অবতীর্ণ হয়েছে?” রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, “যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, আবার জীবন লাভ করে; আবার শহীদ হয় এবং আবার জীবিত হয়, পরে আবার শহীদ হয়, আর তার ওপর অপরিশোধিত ঋণ থাকে, তবে তার পক্ষ থেকে সে ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”’ (নাসাঈ: ৪৬৮৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের ঋণ পরিশোধের দোয়াও শিখিয়েছেন, ‘আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা, ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক (অর্থ—হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল রিজিকের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান এবং আপনার দয়া ও করুণা দিয়ে অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন)’। (তিরমিজি: ৩৫৬৩)
ঋণ আদায়ে কঠোরতাও আরোপ করা যায়। আমর ইবনে শারিদ (রহ.) তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ পরিশোধ না করলে তার মান–সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ করা যায় এবং তাকে শাস্তি দেওয়া যায়।’ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, এর অর্থ হলো—‘তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবে এবং তাকে আটক করা যাবে।’ (আবু দাউদ: ৩৬২৮) ‘জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)–এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিল। সাহাবায়ে কিরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে।’ (বুখারি: ২২৩২,২৪০১, ২৪৩৩)
বর্তমান সমাজে অনেকে ঋণ গ্রহণের পর ওই টাকাকে নিজের সম্পদ মনে করেন। অনেকে টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন। হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে।’ (ইবনে মাজাহ)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com