হায়দার আকবর খান রনো
হায়দার আকবর খান রনো

স্মরণ

সত্যিকার জোড় ভেঙে গেল, বিদায় বন্ধু কমরেড রনো

রনো (হায়দার আকবর খান রনো) চলে গেলেন। ১১ মের ভোররাত ২টা ৫ মিনিটে তাঁর দেহাবসান ঘটেছে। তাঁর এই মৃত্যু আকস্মিক ছিল না। দীর্ঘদিন থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টাই অক্সিজেন নিয়ে থাকতে হতো। সঙ্গে ছিল কাশি।

ভুল চিকিৎসার কারণে এক চোখে একদম দেখতেন পারতেন না।  আরেক চোখে ঝাপসা দেখতেন। কিন্তু এই অবস্থায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মতো যে লড়াইটা তিনি লড়েছিলেন, তা ছিল অতুলনীয়। শারীরিক এই অবস্থার মধ্যেও ডিকটেশন দিয়ে তিনি বই লিখেছেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন।

কয়েক দিন আগে শেষবার যখন তাঁর সঙ্গে কথা হলো, জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা লেখা লিখেছেন। নতুন দিগন্ত পত্রিকায় সেটা ছাপা হবে। কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যেই দ্রুত শারীরিক অবনতি হয় তাঁর। খবর পেয়ে ‘হেলথ অ্যান্ড হোপ’ হাসপাতালের এইচডিইউতে যখন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম, আচ্ছন্ন অবস্থাতেই আমাকে ডেকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন। কী কথা বলতে চেয়েছিলেন, বুঝতে পারিনি। তবে চিনতে পেরেছিলেন ভেবে ভালো লাগছিল। খাওয়ার আগে রাত ১০টায় আবার গিয়েছিলাম, আমার ডাকে সাড়া দিয়ে চোখ মেলেছিলেন। কিন্তু চিনতে পেরেছিলেন কি না, বুঝতে পারিনি।

একটা সময় ছিল, এই সেদিন পর্যন্ত রনো-মেনন নামে সবাই আমাদের চিনত। কিন্তু ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে অবশ্য যে বন্ধুত্ব, সেটা অটুট থেকেছে মৃত্যুপর্যন্ত।

রাশেদ খান মেনন

রনো আপাদমস্তক কমিউনিস্ট ছিলেন। সেই ছেলেবেলা থেকেই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি তাঁর আকর্ষণ আমার মধ্যেও সংক্রমিত করেছিল। আমি শেষ পর্যন্ত কতখানি কমিউনিস্ট হতে পেরেছি জানি না, তবে তাঁর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রজীবনে যে কমিউনিস্ট আদর্শ আঁকড়ে ধরেছিলাম দুজনে মিলে, সেই আদর্শে অবিচল থেকেছি এই শেষ বয়স পর্যন্ত।

আর এ ক্ষেত্রে রনোর প্রতি আমার অকৃত্রিম ঋণ। আন্দোলনের পথচলায়, জেলখানায়, ব্যক্তিজীবনে বন্ধুদের আড্ডায় তাঁর কাছ থেকে কমিউনিজমের পাঠ নিয়েছি।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বাঁক-মোড়ে, ষাটের দশকের মহাবিতর্কের সময় একসঙ্গে মিলে তাতে অংশ নিয়েছি।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা প্রয়োগ করেছি। বিপ্লবী আবেগে কখনো কখনো তাতে ভুল করেছি। আবার রনোই সর্বাগ্রে ভুল শুধরে সঠিক পথ বাতলেছেন। তবে শেষবার যে বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল, সেই ক্ষেত্রে সে সময়কার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে তাঁরই অগ্রগামী ভূমিকা ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি যেটাকে ভুল মনে করেছিলেন, তাতে আমি সায় দিতে পারিনি। ফলে আমাদের দুজনের রাজনৈতিক পথ, এমনকি সাংগঠনিক পথও ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

আমার লেখার শিরোনামে রনোকে কমরেড হিসেবে বলেছি। কিন্তু সারা লেখায় তাঁকে কমরেড হিসেবে বলিনি। রনো আমার কাছে কমরেডই নন, তার চেয়ে বড় কিছু। রাজনীতিতে আমাদের জোড় ভেঙে গিয়েছিল ১৫ বছর আগে। এবার তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের সত্যিকার জোড় ভাঙল। তবে রনোর সঙ্গে আমার আবাল্যবন্ধুত্ব পরিণত বয়সে যে পরিণতি নিয়েছে, তা অটুট থাকবে আমাদের মৃত্যুর পরও।

এখানে কে আমরা সঠিক ছিলাম, সেটা ভবিষ্যতের ইতিহাস নির্ণয় করবে। কিন্তু রাজনীতির ও সংগঠনের ওই কঠোর বিচ্ছিন্নতা আমাদের পৃথক করতে পারেনি। রনোর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই বিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত হলো কি? আমি মনে করি, না। রনোর সঙ্গে যে আত্মিক, রাজনৈতিক, আদর্শগত বন্ধুত্ব ছিল, তা তাঁর ও আমার মৃত্যুর পরও  অটুট থাকবে।

সেই ছোটবেলার কথা। যশোর জিলা স্কুলে একসঙ্গে পড়া, খেলাধুলা, একসঙ্গে সিগারেট খাওয়া শেখা। এ দেশে তখন উন্মাতাল সময়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদের রক্তের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। সামনে নির্বাচন। ঢাকা থেকে বড় তিন ভাই ফিরে এসেছেন ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে। জেল খেটে। মুসলিম লীগের ভাবাদর্শী জেলা জজ পিতার বাসায় আলাদা আবহাওয়া। ওই ততোধিক না বোঝার বয়সেও ভাষার প্রশ্ন, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন, সাম্যের প্রশ্ন কিশোর মনকে আন্দোলিত করেছে। এই সময় রনো এলেন কমিউনিস্ট দেখার আমন্ত্রণ নিয়ে।

রনোর জন্ম কলকাতায়। তাঁর নানা সৈয়দ নওশের আলী তখন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। সে সময় কংগ্রেস ছেড়ে বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন। মামা সৈয়দ মনসুর জিলানি ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই আবহাওয়ায় রনোর কমিউনিজমের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। বড় ভাই সাদেক খানের সাম্যবাদের প্রতি আকর্ষণ আমার মধ্যেও ওই চিন্তার অঙ্কুরোদ্‌গম ঘটাচ্ছিল।

আর তখনই রনোর ঢোলের বাড়ি। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি–হত্যার  ঘটনায় আহত হয়ে বেঁচে যাওয়া তরুণ কমিউনিস্ট আবদুল হক তখন চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগের দাপুটে প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁকে ওই নির্বাচনে প্রচারণার জন্য আনা হয়েছে যশোরে। যশোর রেলস্টেশনে রনো আমাকে নিয়েছিলেন আহত রাজবন্দী কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হককে দেখতে।

সেই প্রথম একজন কমিউনিস্টকে দর্শন। এরপর সময় পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন রনোই আবার আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিস্টদের সুলুকসন্ধান দিয়েছেন। এরপর আর কথা হয়নি। দুজনে মিলে কমিউনিস্ট আদর্শের পথ বেয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। বাষট্টির সামরিক শাসন বিরোধী ও শিক্ষায় আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন পুনর্গঠন, আইয়ুব শাসনের বিরোধিতা, লড়াইয়ে, আত্মগোপনের জীবনে, জেলখানায়, ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তিতে, রনো শ্রমিক আন্দোলনে, আমি কৃষক আন্দোলনে। আবার একত্রে কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তির সময়কালে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠন করার কাজে যুক্ত হয়েছি।

সেটা ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। রনো শ্রমিক আন্দোলনে, আমি কৃষক আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এ সময় আমরা ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে পল্টনের জনসভায় (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কর্মসূচি’ ঘোষণা করি। দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করি, জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। মুক্তি আসবে না।

এর পরবর্তী সময় ’৭০–এর নির্বাচন, ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতকরণ, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রির গণহত্যার মধ্য দিয়ে ওই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথে আমরা অগ্রসর হয়েছি। ঢাকার অদূরে নরসিংদীর শিবপুরে কেন্দ্রীয় ঘাঁটি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা অংশ নিয়েছি। এ সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তথাকথিত পিকিংপন্থীদের একত্র করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন। মাওলানা ভাসানীর অবর্তমানে তাঁকেই প্রধান করে এই কমিটি ১৯৭১ সালের ২ জুন যে ঘোষণা গ্রহণ করে তারও রচয়িতা ছিলেন রনো।

বাংলাদেশে পরবর্তীকালে এই ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ অপর দুটি কমিউনিস্ট গ্রুপ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার) ও কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র একত্র হয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) নামে প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলে রনো তার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। অন্যদিকে আমি একইভাবে ওই পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকলেও আমার প্রকাশ্য অবস্থান হয় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও কৃষক সমিতিতে।

এরপর ভাসানী ন্যাপ থেকে বেরিয়ে এসে ইউপিপি গঠন করলেন কাজী জাফর। সেই ইউপিপিকে নিয়ে তিনি জেনারেল জিয়ার ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে’ যোগ দিলে আমি আর রনো অন্যদের নিয়ে তাতে যোগদান করতে অস্বীকার করে বেরিয়ে এসে গঠন করি ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ নামের প্ল্যাটফর্ম। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রকাশ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি নামে পুনর্গঠিত করা হবে এবং রনো তার সাধারণ সম্পাদক হন।

এরপর বহু ভাগ–বিভক্তি ঐক্যের মধ্য দিয়ে রনোই সবচেয়ে উদ্যোগী ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সেই ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে রনো ২০০৮ সালে বিদায় নেন ও যোগ দেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিকে, তিনি আগে যার বিরোধিতা করে আসছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।

কিন্তু এই সময়কালে রনোর প্রধান মনোযোগ ছিল মার্ক্সবাদী তত্ত্বমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায়, বই লেখায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ওপর নানা বিষয়ে এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে গ্রন্থ রচনায়। রনোর লেখা আত্মজীবনীমূলক বই শতাব্দী পেরিয়ে ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধকে মূর্ত করে তোলে পাঠকের কাছে।

আমার লেখার শিরোনামে রনোকে কমরেড হিসেবে বলেছি। কিন্তু সারা লেখায় তাঁকে কমরেড হিসেবে বলিনি। রনো আমার কাছে কমরেডই নন, তার চেয়ে বড় কিছু। রাজনীতিতে আমাদের জোড় ভেঙে গিয়েছিল ১৫ বছর আগে। এবার তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের সত্যিকার জোড় ভাঙল। তবে রনোর সঙ্গে আমার আবাল্যবন্ধুত্ব পরিণত বয়সে যে পরিণতি নিয়েছে, তা অটুট থাকবে আমাদের মৃত্যুর পরও।

কমরেড রনো, যুগ যুগ জিও।

  • রাশেদ খান মেনন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য