তালেবানের সঙ্গে ভারত কেন সম্পর্কে জড়াচ্ছে

ক্যাপশন সম্প্রতি তালিবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি (মাঝে) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ছবি: রয়টার্স

গত সপ্তাহে আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার ঘোষণার পর ভারত সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। যদিও মুখে মুখে হলেও আল-কায়েদার এই শীর্ষ নেতার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল ভারত। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে জাওয়াহিরি ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের কাছে এ ঘটনার অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তালেবান আফগানিস্তানের মাটি বিদেশি কোনো চরমপন্থী সংগঠনকে ব্যবহার করতে দেবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ড্রোন হামলায় জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার পর আরেকটি তত্ত্বও বেশ চাউর হয়েছে। সেটা হলো, পাকিস্তান আমেরিকার কাছে জাওয়াহিরির অবস্থান-সম্পর্কিত তথ্য জানিয়ে দিয়েছে।

যাহোক কাবুলে ড্রোন হামলায় জাওয়াহিরির নিহত হওয়ার ঘটনা ভারতকে একটু খারাপ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর কারণ হলো, নয়াদিল্লি সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির একটা উদ্যোগ নিয়েছে। গত জুন মাসে কাবুলে আবার দূতাবাস চালু করেছে ভারত। এক বছর আগে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর দূতাবাসটি বন্ধ করে দিয়েছিল নয়াদিল্লি।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত আর তালেবান একে অপরের শত্রু। ভারতের নিরাপত্তাবিশারদেরা মনে করেন, তালেবান পাকিস্তানের প্রক্সি সংগঠন। এর কারণ হলো, ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রথম দফায় যখন তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তখন পাকিস্তান ও ভারতভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের গভীর কৌশলগত সম্পর্ক ছিল।

ভারত তালেবান-পূর্ব আফগানিস্তানের প্রজাতন্ত্রী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। একইভাবে নব্বইয়ের দশকে তালেবানবিরোধী শক্তিকেও সমর্থন করেছিল। এ প্রেক্ষাপটে ভারত ও তালেবান দুই পক্ষ পরস্পর সম্পর্কিত হতে চাইছে—সেটা ভাবা এককথায় বিস্ময়কর। হ্যাঁ, মতাদর্শ নয় বাস্তব বিবেচনার রাজনীতি—এ মুহূর্তে দুই পক্ষকে কাছাকাছি এনেছে। আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছে তালেবান। আফগানিস্তানের অর্থনীতি ধসে পড়েছে। স্মরণকালের তীব্রতম খরায় পরিস্থিতি আরও ঘোরতর হয়েছে। জুন মাসে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে আফগানিস্তানে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

কেননা, ভূকৌশলগত অবস্থান ও বিপুল পরিমাণ খনিজ মজুতের কারণে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান ভবিষ্যতে আবারও পরাশক্তির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই তালেবান সরকার চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিকে তামার খনি খননের কাজ শুরু করার আহ্বান জানায়। ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের কেউই চায় না আফগানিস্তান বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত ৩০ হাজার মেট্রিক টন গম ও ৫ লাখ ডোজ কোভিড টিকা পাঠায় কাবুলে। অপর দিকে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে তালেবানের হিতাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিত। ভারত আফগানিস্তানকে যে মাত্রায় সহায়তা করেছে, তার তুলনায় পাকিস্তান তেমন কিছুই করেনি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাকিস্তান-তালেবান সম্পর্কে বেশ উত্তেজনা বেড়েছে। আগের সরকারের মতো তালেবান সরকারও আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারাও এটিকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আচরণ বলে সমালোচনা করেছে। পাকিস্তান তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে চাইলে তালেবান সীমান্তরক্ষীরা বারবার করে বাধা দিয়ে এসেছে।

পাকিস্তানবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবানের (টিটিপি) কর্মকাণ্ডে লাগাম পরাতে ব্যর্থ হওয়ায় কিংবা অনিচ্ছুক হওয়ায় ইসলামাবাদ তালেবানের ওপর সন্তুষ্ট নয়। গত এপ্রিল মাসে টিটিপির ঘাঁটি আছে ধারণা করে পাকিস্তান আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ আফগান নাগরিক নিহত হন। তালেবানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এই বিমান হামলা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতার রাস্তা’ পাকা করল। তালেবান-পাকিস্তানের এই তিক্ত সম্পর্ক সম্ভবত নয়াদিল্লির জন্য একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

ভারত সম্ভবত উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার মধ্য দিয়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক শুরু করেছে। এর বিনিময়ে দিল্লি এই নিশ্চয়তা চায় যে, আফগানিস্তানের মাটি ভারতবিরোধী কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। নয়াদিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। গত মে মাসেই জাওয়াহিরি ভারতকে হুমকি দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তালেবান সরকার যাতে বিব্রত অবস্থায় না পড়ে, সে জন্য নয়াদিল্লি এ বিষয়ে নীরব রয়েছে।

ভারতের গণমাধ্যমগুলোয় বলা হয়েছে, জাওয়াহিরির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান তালেবানের পিঠে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত হাক্কানি নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি উপত্যকায় জাওয়াহিরি অবস্থান করছিলেন বলে ভারতের গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।ঐতিহাসিক শত্রুতা থাকার পরও নয়াদিল্লি ও তালেবান দুই পক্ষই গত কয়েক মাসে এমন মনোভাব দেখিয়েছে যে তাদের আর শত্রুতা বজায় রাখার দরকার নেই। এমনকি ২০১৯ সালে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের জন্য পাকিস্তান দৌড়ঝাঁপ শুরু করলে ভারত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। সে সময় তালেবান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিল, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

নয়াদিল্লি তালেবানের প্রতি বৈরী আচরণ করা থেকে বিরত রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে আফগানিস্তান ইস্যুতে আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করেছিল ভারত। সেখানে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী সামরিক জোট গঠন করা ভারতের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু বহুজাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যাতে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না পারে, সেটা প্রতিরোধ করতে হবে। গত মে মাসে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আরও এক ধাপ এগিয়ে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী সামর্থ্য বাড়ানোর আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি যেটা বলেননি তা হলো, তালেবান সরকারকে যখন বিশ্বের কোনো দেশই স্বীকৃতি দেয়নি, তখন সেটা কীভাবে করা সম্ভব।

এ প্রশ্নের সূত্র পাওয়া যাবে এ মাসে কাবুলে ফেরত যাওয়া ভারতে প্রশিক্ষিত ২৫ সেনাকে আটকের পরিবর্তে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানোর ঘটনা থেকে। আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজউদ্দিন হাক্কানি আগের সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ২৫ সেনার কোনো ক্ষতি করা হবে না বলে প্রথমে ঘোষণা দেন। এরপর আবার ঘোষণা দেন, তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হবে। তালেবান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব তালেবান সেনাদের যাতে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন। খোরাসান প্রদেশের আইএসআইএস সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে তালেবানের পক্ষ থেকে এ আহ্বান এসেছে।

২০০৮ সালে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে হামলার জন্য দায়ী করা হয় হাক্কানি নেটওয়ার্ককে। সেই হাক্কানি নেটওয়ার্কের সিরাজউদ্দিন হাক্কানি এখন আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এরপরও নয়াদিল্লি তালেবান সরকারের সঙ্গে একটু সেতু তৈরি করতে চায়। কেননা, ভূকৌশলগত অবস্থান ও বিপুল পরিমাণ খনিজ মজুতের কারণে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান ভবিষ্যতে আবারও পরাশক্তির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই তালেবান সরকার চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিকে তামার খনি খননের কাজ শুরু করার আহ্বান জানায়। ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের কেউই চায় না আফগানিস্তান বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে

  • দিনেশ কামাত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক