ইসরায়েলের হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মুখে কুলুপ কেন

ইসরায়েলি হামলায় সব হারানো ফিলিস্তিনিদের বুক ফাটা আর্তনাদ বিশ্বশক্তিগুলোকে স্পর্শ করছে না।
ছবি: এএফপি

বছর পাঁচেক আগের কথা।

কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে গাজীপুরে যাচ্ছি। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছি। দৃশ্যগুলো ছুটে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল, গাছপালা সরে সরে যাচ্ছে; যেমন যায়।

ক্রমশ সরে যেতে থাকা একটা দেয়ালে আচমকা চোখ আটকে গেল। দেয়ালে আলকাতরা জাতীয় কিছু দিয়ে বেশ বড় করে ইংরেজি হরফে লেখা, ‘উই লাভ প্যালেস্টাইন। উই আর উইথ প্যালেস্টাইন’।

কথাটা যে দেয়ালে লেখা, সেটি খুব বিবর্ণ। লেখাটাও মনে হচ্ছিল অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই বিবর্ণ দেয়ালের অপস্রিয়মাণ লেখাটা দেখে মনে হচ্ছিল, যদি কোনো দিন কোনো ফিলিস্তিনির সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তাঁকে বলব, ‘দ্যাখো, আমরা যে তোমাদের সঙ্গে আছি, তা আমাদের মামুলি কথার কথা না। তোমাদের মুক্তির জন্য আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন একজন মানুষও প্রাণভরে দোয়া করে। তোমাদের ওপর হামলার খবর শুনলে আমাদের এখানে সবাই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ডান-বাম সব একাকার হয়ে যায়।’

একটা সময় ছিল অন্তত এই একটি ইস্যুতে আমাদের সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত ঐকমত্য ছিল। গাজা বা পশ্চিম তিরে ইসরায়েলি হামলায় রাস্তায় সবাই মিছিলে নামত। সেই মিছিলে যাঁরা যোগ দিতেন, তাদের প্রত্যেকের শারীরিক ভাষা বলে দিত, ফিলিস্তিনি মজলুমদের মুক্তি চাওয়ার বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো চালাকি নেই। কোনো ধান্দা নেই। কোনো স্বার্থ নেই। কাউকে খুশি বা কাউকে অখুশি করার উদ্দেশ্য নেই।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কোনো ফিলিস্তিনির সঙ্গে দেখা হলে সেই কথাটি আর জোর দিয়ে বলতে পারব না। কারণ এবার গাজায় ইতিহাসের বর্বরতম ইসরায়েলি হামলায় যখন শত শত ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে; সেই ধ্বংসাবশেষের নিচে যখন হাজারো নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের লাশ পচে গোটা গাজার আকাশ-বাতাসকে বীভৎস করে তুলছে; যখন ফেরেশতার মতো ফুটফুটে শিশুদের ওপরও ইসরায়েলি হানাদারদের সামান্যতম দয়ামায়া দেখাতে দেখা যাচ্ছে না; তখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর এক অদ্ভুত নীরবতা আর সতর্ক ও উপরচালাকি ভরা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের ওপর কিংবা হিজবুল্লাহ দমনের নামে লেবাননের ওপর যখন ইসরায়েল টানা বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ খুন করতে থাকে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ পশ্চিমা মোড়লদের একটি মুখস্থ বক্তব্য ঝাড়তে দেখা যায়। সেটি হলো: ‘এই সংকট সমাধানে উভয় পক্ষকে সংযত হতে হবে। আমরা উভয় পক্ষের প্রতি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানাই।’

অর্থাৎ তারা এই কূটনৈতিক প্যাঁচ মারা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আগ্রাসনের শিকার ও আগ্রাসী শক্তিকে এক পাল্লায় মাপতে থাকে। তারা একপক্ষীয় নিষ্ঠুর হামলাকে ‘সংঘাত’ হিসেবে দেখাতে থাকে। তাদের কথায় মনে হতে থাকে, যেন দুটো সমান শক্তি সমান বর্বরতায় পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা মূলত ইসরায়েলের বর্বরতাকেই ‘জায়েজ’ করতে থাকে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পশ্চিমারা তাদের সেই পাঠ আমাদের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোকে পাখিপড়া করিয়েছে। মনে হচ্ছে, আমাদের নেতারা পশ্চিমাদের সেই  চালাকি কথার গরল গেলাসে গেলাসে গলা পর্যন্ত গিলেছেন। ফিলিস্তিনের ওপর এবারের ইসরায়েলি হামলায় মনে হচ্ছে তাঁরা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায় পড়ে গেছেন।

গত ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়কে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের জন্য এবং দুপক্ষেই আরও নিরীহ প্রাণহানি এড়াতে অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানাই।’

খেয়াল করুন, যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যের সঙ্গে এই বিবৃতির কী মারাত্মক মিল!

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির অনেকটা সম্পূরক ব্যাখ্যার মতো করে ১০ অক্টোবর তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সব সময়ই যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে এবং যুদ্ধের নামে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা কখনো সমীচীন নয়। এটি যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনেরও পরিপন্থী।’

তিনি বলেছেন, ‘সেখানে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল যেখানেই হোক, সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ড আমরা সমর্থন করি না।’
ফিলিস্তিনের প্রতি এই ম্যাড়মেড়ে সমর্থন যে মোটেও কুণ্ঠামুক্ত নয়, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ ক্ষেত্রে বিএনপিও সরকারের লাইনে হাঁটছে। বিএনপির বিদেশে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেল এক্স-এ ফিলিস্তিন নিয়ে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। দলটির দেশে থাকা নেতারা চুপটি করে আছেন।

এই ধরনের ইস্যুতে সাধারণত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে থাকেন। কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুতে এবার তিনিসহ সব নেতাই নীরব হয়ে আছেন।

খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে।

একটি সংবাদ পোর্টালকে বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সুসম্পর্কের কারণে কোনোভাবেই বিতর্কিত কোনো অবস্থান নেবে না বিএনপি।’ বিষয়টি কি আসলেই তাই?

অবস্থানগত কারণে সরকারের যেসব বাধ্যবাধকতা থাকে, বিরোধী দলের সামনে তা ততটা না থাকায় তাদের সোচ্চার হওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু সেই সহজ জিনিসটাই এখন সম্ভবত বিএনপির জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন সরকারের পতন ঘটানো প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমের ওপর অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

গত ১৫ অক্টোবর মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা একা নই। পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্রের পক্ষে কমিটেড (অঙ্গীকারবদ্ধ)। এই অঙ্গীকার আমাদের সাহস জোগাচ্ছে।’ সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর আরেক কাঠি সরেস। তিনি বলেছেন, ‘পিটার হাস (বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত) আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন।’

ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় মারা যাওয়া সন্তানের এপিটাফহীন কবরের পাশে বসে কোনো এক মাকে হয়তো দানবের মতো ছুটে আসতে থাকা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন, এখন সবার ওপর স্বার্থ সত্য। এখন ধর্মের নয়, স্বার্থের কল বাতাসে নড়ে

বিএনপিসহ সব বিরোধী দল জানে, গোটা পশ্চিমই ইসরায়েলের অকুণ্ঠ সমর্থক। তারা আরও জানে, ‘গরম ভাতে বিলাই বেজার, উচিত কথায় বন্ধু বেজার।’

সেই কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উচিত কথা বলে তাঁরা বন্ধু তথা ‘অবতার’কে বেজার করতে চান না। এর মধ্যে বাম ও ধর্মভিত্তিক ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে যতটুকু প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে, সেটিও স্পষ্টতই দায়সারা গোছের।

অন্যদিকে, আনার ফুলের মতো টুকটুকে রাঙা যে ফিলিস্তিনি শিশুগুলো জয়তুন গাছের তলায় পলান-টুকটুক খেলছিল; একচোখা দানব দাজ্জালের মতো ছুটে আসা ইসরায়েলি বোমায় তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

ত্বীন আর সাম্মাম ফলের খামারে কাজ করতে করতে বুড়িয়ে যাওয়া যে দাদীমা তার নাতিপুতিকে কোলের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে মহা উদ্বেগে রাত পার করছিলেন, তিনিও বুঝে উঠতে পারেননি কীভাবে বিমান থেকে ফেলা বোমায় বহুতল বিল্ডিংটা সেকেন্ডের মধ্যে তাদের সবার ওপর বসে পড়েছে।

ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় মারা যাওয়া সন্তানের এপিটাফহীন কবরের পাশে বসে কোনো এক মাকে হয়তো দানবের মতো ছুটে আসতে থাকা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন, এখন সবার ওপর স্বার্থ সত্য। এখন ধর্মের নয়, স্বার্থের কল বাতাসে নড়ে।  

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই–মেইল: sarfuddin2003@gmail.com