ফিলিস্তিনের হতবাক করা হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাস

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ছিল, তাতেও ভয়ংকরভাবে চিড় ধরেছে।
ছবি : রয়টার্স

ফিলিস্তিনিদের এই হামলা চমকে দেওয়ার মতোই—বর্ষীয়ান ইসরায়েলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার মেরন র‌্যাপোপোর্ট মিডল ইস্ট আইকে বলছিলেন। তাঁর মতে, ইসরায়েল হতোদ্যম, নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ আর ইসরায়েলের হাতে নেই।

এ দফায় হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্য গোষ্ঠীগুলো যেভাবে যুদ্ধ করছে, ১৯৪৮ সালের পর তেমনটি আর দেখা যায়নি বলে মনে করেন মেরন। ওই বছর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান ঘটেছিল।

মেরন বলেন, এমনকি অর্ধশতাব্দী আগে ১৯৭৩ সালে যখন মিসর আচমকা ইসরায়েলে আক্রমণ করে, তখনো কেউ এতটা বিস্মিত হয়নি। ওই যুদ্ধকে ইসরায়েলিরা ‘ইয়ম কিপ্পুর’ বলে অভিহিত করে। এবারকার হামলায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হতবাক হয়ে গেছে। তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ছিল, তাতেও ভয়ংকরভাবে চিড় ধরেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু গত শনিবারই ২৫০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলিরা একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এবার যারা যুদ্ধ করছে, তাদের হাতে কালাশনিকভ ছাড়া কিছু নেই। এটা অবিশ্বাস্য। ইসরায়েলের এই সেনা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা তাদের অনেক দিন ভোগাবে।

ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে গাজা উপত্যকার আশপাশে নজরদারির জন্য শৌখিন ও বহুমূল্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এই অঞ্চলকে তারা ২০০৭ সালে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। মেরন বলেন, ওখানে ক্যামেরা ও আকাশে ড্রোন ওড়ার কথা। এই বেষ্টনী অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব। ফলে ইসরায়েলের যে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি, তাতে এই আঘাত অকল্পনীয়। কারণ, ৮২০০ নামে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে গোয়েন্দা ইউনিট আছে, তাদের কাছে ফিলিস্তিনিদের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যও আছে। অথচ তারা জানতে পারেনি যে কয়েক শ বা হাজারখানেক যোদ্ধা এমন জটিল ও ব্যাপক হামলা চালাবে। তাদের কোনা ধারণাই ছিল না।

ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েলি শহরে হেঁটে–ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ইসরায়েলি নারী, শিশু ও বয়স্কদের জিম্মি করছেন, এর একটা গভীর প্রভাব ইসরায়েলি জনগোষ্ঠীর ওপর পড়বে। আমরা দেখলাম, মেয়েরা ফিসফিস করে ফোনে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলকে খবর দিচ্ছেন যে তাঁরা একা হয়ে গেছেন। বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে এবং সারা দিনেও সেনাবাহিনীর কোনো দেখা নেই। এই ঘটনা এত সহজে ইসরায়েলিরা ভুলবে না।

নেতানিয়াহু কী করতে যাচ্ছেন

ইসরায়েল সরকার এখন কী করবে, তা পরিষ্কার নয়।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত সবটুকু এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর এই অঙ্গীকার নিশ্চিতভাবেই ধাক্কা খেয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রথমেই যা করতে চাইবে তা হলো, গাজাকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। এতে হতাহতের সংখ্যা হাজার ছাড়াবে দ্রুতই। ইতিমধ্যে শনিবারের বিমান হামলায় ২৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

কিন্তু সামরিক প্রেক্ষাপট থেকে এ ধরনের বিমান হামলার কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, এতে হামাসকে থামানো সম্ভব হবে না। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা এখন পর্যন্ত ১৫০ ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছেন। ফিলিস্তিনিদের বোমা মেরে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা এসব জিম্মিকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী গাজা পুরোপুরি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে এ জন্য যে আত্মবিশ্বাস দরকার, সেটা তাদের নেই। তারপরও তারা যদি গাজা পুরোপুরি দখল করে নিতে চায়, তাহলে গাজার হাজার হাজার লোক নিহত অথবা বাস্তুচ্যুত হবেন। শত শত ইসরায়েলিও খুন হবেন।

মেরন বলেন, ইসরায়েল এমন এক পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যেখানে তারা আর নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাদের আত্মবিশ্বাস এখন তলানিতে। একই অবস্থা সেনাবাহিনীতেও। সেনাবাহিনী নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে, ইসরায়েলিরা বিশ্বাস হারিয়েছে সেনাবাহিনীর ওপর। গাজা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে এসবের ব্যাপক প্রভাব থাকবে।

গাজায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, শরণার্থী সংকটের আশঙ্কা বড় পরিসরে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারে। এই যুদ্ধে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের একাধিক গোষ্ঠী, পশ্চিম উপত্যকা ও জেরুজালেমের বেসামরিক জনগোষ্ঠী, সিরিয়া ও জর্ডানের যুক্ততার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নেতানিয়াহু তাঁর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচের পরামর্শ অনুযায়ী গাজা পুরোপুরি দখলের উদ্যোগ নিতে পারেন। অথবা তিনি আপসের চেষ্টা করতে পারে। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধের পর ইসরায়েলিরা যুদ্ধ ও প্রাণহানির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

মেরন মনে করেন, নেতানিয়াহু এখন যা-ই করুন না কেন, তাঁর সরকারের প্রতি চূড়ান্ত আঘাত এসেছে। এই হামলা তাঁর সরকারকে দুর্বল করবে। ফিলিস্তিনিদের দেয়াল দিয়ে আটকে রেখে চাবি ছুড়ে ফেলা এবং একই সঙ্গে দুবাইয়ের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা নেতানিয়াহু করেছেন, তা কতটা অসার ছিল, সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। যা ঘটেছে, সেটার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।

ইসরায়েল এমন এক পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যেখানে তারা আর নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাদের আত্মবিশ্বাস এখন তলানিতে।

সীমান্ত পাহারা না দিয়ে ৩৩টি ব্যাটালিয়ন পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। নেতানিয়াহু সরকারে চরমপন্থী এবং উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা রয়েছেন, যাঁরা যেকোনো মূল্যে পশ্চিম উপকূলে ইহুদিদের বসতি স্থাপন করতে চান। কিন্তু অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি তাদের এই অতি মনোযোগই পতনের কারণ হয়ে উঠতে পারে। অচিরেই আমরা এমন কথা শুনব যে কেন আমরা নিজেদের বিপন্ন করে এই অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সুরক্ষা দিচ্ছি?

র‌্যাপোপোর্ট বলেন, ইসরায়েল এমন এক পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যেখানে তারা আর নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাদের আত্মবিশ্বাস এখন তলানিতে। একই অবস্থা সেনাবাহিনীতেও। সেনাবাহিনী নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে, ইসরায়েলিরা বিশ্বাস হারিয়েছে সেনাবাহিনীর ওপর। গাজা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে এসবের ব্যাপক প্রভাব থাকবে।

  • লুবনা মাসারওয়া মিডল ইস্ট আইয়ের সাংবাদিক। মিডল ইস্ট আই একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। জেরুজালেমে লুবনা মাসারবার সঙ্গে গাজা-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে কথা বলেন ইসরায়েলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার মেরন র‌্যাপোপোর্ট

  • ইংরেজি থেকে বাংলায় সংক্ষেপিত অনূদিত।