মতামত

পুতিন কি নিজের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারবেন?

২০১১ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর পুতিন বার্ষিক শৌখিন হকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। এবার সেটা বাতিল করেছেন তিনি।
ছবি : রয়টার্স

যে ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভোগেন না কেন, সম্প্রতি তাঁর স্বাস্থ্যের যে গুরুতর অবনতি হয়েছে—এমন জল্পনা চলছে। গত সপ্তাহে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বাতিল করেন পুতিন। তাঁর স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত জল্পনা তাতে আরও দানা বেঁধেছে।

প্রতিবছর সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের সামনে উপস্থিত হয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলেন পুতিন। এবারে সে আয়োজন বাতিল করা হয়েছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা প্রশ্নে এ সংবাদ সম্মেলন ক্রেমলিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল। এ সুযোগ হারানো স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক বলতে চাইছেন, সাংবাদিকদের কঠোর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক নন পুতিন। কিন্তু পুতিন একজন ঝানু রাজনীতিবিদ, তিনি রাশিয়ার মূল্যবোধের প্রচারক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপনও করতে চান। পুতিন বিশ্বাস করেন, পশ্চিমা বিশ্ব (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা সনাতনী খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে পুতিন আবার সেই যুক্তি সামনে আনতে পারতেন এবং তাঁর বিশ্বাসের পক্ষে জনমত আরও শক্তিশালী করতে পারতেন।

পুতিন তাঁর বছরব্যাপী জনপ্রিয় কর্মসূচি ‘সরাসরি সংযোগ’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানও বাতিল করেছেন। এ কর্মসূচি পুতিনের সঙ্গে সাধারণ রাশিয়ানদের সরাসরি কথা বলা, তাদের অভিযোগ জানানো ও সমস্যা সমাধানের একটি মঞ্চ। পুতিন তাঁর এই ‘সরাসরি সংযোগ’ কর্মসূচিকে ব্যবহার করে খুব কার্যকরভাবে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো সমাধান করেন। তাদের মধ্যে তিনি এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন যে আমলাতন্ত্র জনগণের কাজে যতটা না বাধা সৃষ্টি করে, তার চেয়ে তাদের অনেক বেশি সহায়তা করে।

সরকারের মুদ্রানীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য সুবিধা ও সেবা তাদের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করে। এটি খুব গোছালো একটি আয়োজন। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুতিন নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানো সুযোগ পান। সে কারণে ‘সরাসরি সংযোগ’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার কারণ নেই।

তৃতীয় যে অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন, সেটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১১ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর পুতিন বার্ষিক শৌখিন হকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। এ খেলায় পুতিন নিয়মিত অংশ নেন, কেননা এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পৌরুষ ও খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা তুলে ধরতে পারেন।

পুতিনের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না আসায় সংবাদমাধ্যমের জল্পনায় এখন একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার বাইরের অনেক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, পুতিনের কোলন ক্যানসার হয়েছে এবং সেটা এখন ছড়িয়ে পড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে কিংবা উত্তরাধিকার নির্বাচন করে যেতে পুতিনের হাতে সময় খুব কম। পুতিনের আসলে কী ঘটেছে, তিনি আসলে কী করতে চাইছেন, সেটা জানা অসম্ভব।

ধারণা করা হচ্ছে, ৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার মূল ভূমির সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযোগকারী কার্চ সেতুতে সফরের পর থেকে পুতিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ওই দিন মার্সিডিজ কার চালিয়ে সেতুটি অতিক্রম করছেন পুতিন। একপর্যায়ে সেতুর ওপর থেমে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটি মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।

সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বাজে আবহাওয়ার মধ্যেই পুতিন দ্রুত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁকে বেশ সুস্থও দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার বাইরের কিছু সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ৫ ডিসেম্বর পুতিন তাঁর সরকারি বাসভবনের সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন। পুতিন সেদিন উড়োজাহাজ অথবা হেলিকপ্টারে করে ব্রিজের কাছে গিয়ে সন্ধ্যার আগেই মস্কো ফিরে আসতে পারেন। সেটা হলে গত সপ্তাহে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বাতিলের ঘটনা থেকে সিঁড়িতে তাঁর পড়ে যাওয়ার তত্ত্বটি গ্রহণযোগ্য হয়।

১৬ ডিসেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার দ্য স্পেকটাটরে একটি নিবন্ধে ‘কীভাবে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানো যাবে’—এ উপদেশ দিয়েছেন। ওই নিবন্ধে কিসিঞ্জার লেখেন, ‘অনেকে বলেন এই যুদ্ধে নির্বীর্য হয়ে পড়েছে রাশিয়া। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। সহিংসতা প্রবণতার মধ্য দিয়ে গত এক সহস্রাব্দের অর্ধেকটা সময় বৈশ্বিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় তারা নিষ্পত্তিমূলক অবদান রেখে চলেছে। রাশিয়ার সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা একটুও ক্ষয় হয়নি।’

কিসিঞ্জারের যুক্তি হলো, ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন অবস্থান অথবা কৌশলগত নীতি ধ্বংস করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। এ কারণে রাশিয়া দুর্ভেদ্য একটি জনপদ। রাশিয়ার সমাজগুলো সহিংসতার মধ্য দিয়ে তাদের বিরোধ সমাধান করে। অন্য দেশও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সমস্যা সমাধান করার পথ খুঁজতে পারে। হাজার হাজার পারমাণবিক বোমার কারণে এ ঘটনাগুলোর বিপদ তৈরি হচ্ছে। রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।

দুর্ভাগ্যবশত, কিসিঞ্জার তাঁর নিবন্ধে এমন কোনো সমাধান হাজির করেননি, যেটি বর্তমান বাস্তবতায় রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন গ্রহণ করতে পারে।

রাশিয়ার সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত সংবাদমাধ্যম আরটিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিসিঞ্জারের লেখাটি আদ্যোপান্ত পড়তে আগ্রহভরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনো তিনি সময় করে উঠতে পারেননি।

পেসকোভের বিবৃতি থেকে একটা পরিষ্কার ইঙ্গিত মিলছে। সেটা হলো, পুতিন এখন কিসিঞ্জারের নিবন্ধটি পড়তে পারছেন না এবং লেখাটি নিয়ে মন্তব্যও করতে পারছেন না। পুতিন কেন তিনটি অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন, এর একটা ধারণা পেসকোভের বিবৃতি থেকে পরিষ্কার হয়।

পুতিনের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না আসায় সংবাদমাধ্যমের জল্পনায় এখন একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার বাইরের অনেক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, পুতিনের কোলন ক্যানসার হয়েছে এবং সেটা এখন ছড়িয়ে পড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে কিংবা উত্তরাধিকার নির্বাচন করে যেতে পুতিনের হাতে সময় খুব কম। পুতিনের আসলে কী ঘটেছে, তিনি আসলে কী করতে চাইছেন, সেটা জানা অসম্ভব।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত