সন্দ্বীপে জন্ম বিধায় দ্বীপের প্রতি আমার সহজাত আকর্ষণ। দেশের প্রধান দ্বীপগুলোতে ঘুরেছি। দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে থেকেছি, শিক্ষকতা করেছি। সে হিসেবে মালদ্বীপ আমাকে বরাবরই টেনেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সুযোগও হয়েছিল মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে সার্কের সভায় যোগ দেওয়ার। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার কারণে পরপর দুটো বৈঠক মুলতবি হয়। ফলে সেখানে যাওয়া হয়নি। এবার ব্যক্তিগত সফরে মালদ্বীপ গিয়ে সে আক্ষেপ মিটেছে।
মালদ্বীপে গিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রথমেই তিনটি বিষয় আপনার নজর কাড়বে। এক. মালদ্বীপের প্রায় সবাই ভালো ইংরেজি বলে। দুই. দ্বীপের মানুষগুলো হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী ও পর্যটকবান্ধব। তিন. রাস্তাঘাট নিরাপদ, গভীর রাতেও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নারীদের একক আনাগোনা দেখেছি।
সবাই ভালো ইংরেজি বলার কারণ হলো, এখানে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শিক্ষকদের মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও স্থানীয় লোকজন এখন সে দায়িত্ব পালন করছেন।
মালদ্বীপে তিন বছর বয়স থেকেই পড়াশোনা শুরু হয়। শিশুরা এসব বিদ্যালয়ে সাধারণ পাটিগণিত, ধিবেহী ভাষা, সামান্য আরবি ও কোরআন পাঠ করতে শেখে। এ সময়েই তাদের ইংরেজি বর্ণমালার পরিচয় ঘটে। পরিবার ও স্কুল থেকে তারা নৈতিক শিক্ষা লাভ করে। প্রকৃতি ও পরিবেশ তাদের হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল হওয়ার ও নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণের অভ্যাস গড়ে দিয়েছে।
মালদ্বীপ এশিয়ার ক্ষুদ্রতম দেশ। সমুদ্রসমেত যার আয়তন ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ভূমির পরিমাণ মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার, ভূমিপৃষ্ঠ থেকে যার গড় উচ্চতা ১ দশমিক ৫ মিটার।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মালদ্বীপের জনসংখ্যা ৫ লাখ ৫০ হাজারের মতো। এসব পরিসংখ্যান বিবেচনায় মালদ্বীপ অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবু কিছু তুলনামূলক পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরছি।
মালদ্বীপ একটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। ২০২২ সালে মালদ্বীপের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১০ হাজার ৮৮০ মার্কিন ডলার, ভারতের ২ হাজার ৩৯০, বাংলাদেশের ২ হাজার ৮২০ এবং ভুটানের ৩ হাজার ৫১২ মার্কিন ডলার।
উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া ছাড়াও মালদ্বীপ অপেক্ষাকৃত কম আয়বৈষম্যের দেশ। মালদ্বীপের আর্থিক বৈষম্যের জিনি সহগ ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতের ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ, বাংলাদেশের ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ভুটানের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
মানব উন্নয়ন সূচকেও মালদ্বীপ এগিয়ে। মালদ্বীপের মানব উন্নয়ন সূচক ০.৭৪৭ ও অবস্থান ৯০, ভারতের মানব উন্নয়ন সূচক ০.৬৩৩ ও অবস্থান ১৩২ এবং বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক ০.৬৬১ ও অবস্থান ১২৯।
এবার নিবন্ধের শিরোনামে ফিরে যাই। আসলেই প্রকৃতি ও সমুদ্রের নোনা পানিই তাদের সম্পদ। তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের ২৮ শতাংশ ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তির ৬০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ খাত মৎস্য। দুটি খাতই প্রকৃতি ও সমুদ্রনির্ভর। তাহলে মালদ্বীপ কী করে উচ্চমধ্যম আয়, উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক ও কম আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হলো?
মালদ্বীপে প্রায় শতভাগ মানুষ লিখতে ও পড়তে জানে। একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ বাদে সবাই উচ্চশিক্ষিত। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু যুক্তরাজ্য থেকে পুরকৌশল বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। ফলে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে সমুদ্রই তাঁদের একমাত্র সম্পদ। এটাকেই সংরক্ষণ ও বিকশিত করে তাঁদের বাঁচতে হবে। এ জন্য তাঁরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে আসেন।
মালদ্বীপের মোট ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪২৬ জন নিবাসীর মধ্যে ১ লাখ ৭৮ হাজার ১৫৬ জনই (প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) বিদেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ৯০ হাজারের বেশি। মালদ্বীপে অবস্থানকালে বাংলাদেশি ব্যাংকার, নির্মাণশ্রমিক ও ব্যবসায়ী; ইন্দোনেশিয়ার পর্যটনকর্মী, শ্রীলঙ্কান শিক্ষক ও পাচক, স্পেনের স্নোরকেলিং প্রশিক্ষক, ওলন্দাজ পানিবিশেষজ্ঞ, ভারতের চিকিৎসক, নার্স, হিসাবরক্ষক, জার্মান রিসোর্ট ম্যানেজার দেখেছি। মালডিভিয়ান ও বিদেশি দক্ষ কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করে মালদ্বীপকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক সরকারি ব্যয় সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মালদ্বীপের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাক্রমে গড়ে বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ বা জিডিপির ৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ১ শতাংশ বা জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ২ দশমিক ৬৩ ও ২ শতাংশ মাত্র। কেবল এই উপাত্ত থেকেই মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের অগ্রাধিকার বোঝা যায়। এ জন্যই মানব উন্নয়ন সূচকে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৯০ ও ১২৯তম।
মালদ্বীপ ও সন্দ্বীপের ভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ২৯৮ ও ৭৬২ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্র যোগ করলে মালদ্বীপের আয়তন ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মালদ্বীপে এসে তাই সন্দ্বীপের কথা মনে পড়ল। মাত্র ৮৮ কিলোমিটার সড়ক বাদ দিলে মালদ্বীপের পুরো যাতায়াতব্যবস্থাই জলযাননির্ভর।
ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই আমাদের গন্তব্য মাফুশি দ্বীপে যেতে বোটে উঠতে হলো। তিনজন নাবিকসহ ৬৩ আসনের বোটটিতে আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। ‘গালফ ক্রাফট ট্যুরিং ৪৮ সিরিজের’ বোটটি আরব আমিরাত ও মালদ্বীপে যৌথভাবে নির্মিত হয়েছে। বোটটিতে ২৫০ অশ্বশক্তির চারটি আউটবোর্ড ইঞ্জিন, যা ৩৮ নট গতিতে চলতে পারে। বোটটি রাডার, ওয়াকিটকিসহ সমুদ্রযাত্রার সব সরঞ্জামে সজ্জিত। প্রত্যেক যাত্রীর জন্য আধুনিক লাইফ জ্যাকেট বিমানযাত্রীদের মতো।
উত্তাল সমুদ্রে ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ৪৫ মিনিটে মাফুশি দ্বীপে পৌঁছালাম। একদম ডাঙা থেকে ডাঙায়। ভাড়া ২০ মার্কিন ডলার, মালামালের জন্য আলাদা কোনো ভাড়া নেই।
সন্দ্বীপযাত্রার কষ্টের কথা মনে পড়ল। কুমিরা ঘাট থেকে আবহাওয়াভেদে ভ্যানে অথবা নৌকায়, কাদাপানি পার হয়ে মুরগি অথবা গবাদিপশুর মতো আঁটাআঁটি করে স্পিডবোট, যাতে নেই কোনো লাইফ জ্যাকেট, রাডার, ওয়াকিটকি বা অন্য কোনো নৌযান পরিচালনার সরঞ্জাম। এরপর জান হাতে নিয়ে যাত্রা। ওপারেও একই কসরত!
পাথর ফেলে সমুদ্রের ঢেউ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখানে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে নৌযান ও ফেরি যাতায়াতের জন্য। নৌযান ও ফেরি রাস্তার পাশে জেটিতে যাত্রী ও পণ্য নামিয়ে দেয়। সব দ্বীপেই একই ব্যবস্থা। অথচ সন্দ্বীপে কেবল ঘাট বানানো হচ্ছে। প্রথমে ১০ কোটি টাকা দিয়ে একটা, পরে ৪০ কোটি টাকা দিয়ে আরেকটা, এখন ৩০০ কোটি টাকা দিয়ে আরেকটা করা হচ্ছে। সরকার কা মাল দরিয়ামে ঢাল! সমুদ্রের ঢেউ নিয়ন্ত্রণ না করে এ ধরনের অপব্যয় কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।
রাজধানী মালে-সংলগ্ন হুলুমালে সৃষ্টি করা হয়েছে গভীর সমুদ্র থেকে বালুমাটি এনে উপহ্রদ ভরাট করে। সফল প্রথম পর্যায়ের পর এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। সন্দ্বীপের আশপাশে বিপুল পরিমাণ চর জেগে উঠেছে। এর কোনো কোনো জায়গায় ভূমি পুনরুদ্ধার করলে সন্দ্বীপকে নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব। বাংলাদেশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
ওলন্দাজরা হুলুমালু (মালদ্বীপের দ্বীপ) পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। আমরা ওলন্দাজদের দিয়ে বদ্বীপ পরিকল্পনা বানাই। কিন্তু মানুষের উপকার হয়, এমন কাজের কাজ কিছুই হয় না। বাংলাদেশ সমুদ্র ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মালদ্বীপ থেকে শিখতে পারে।
পরের কিস্তিতে ভূস্বর্গ বলে পরিচিত মালদ্বীপের সমস্যা, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বিষয়ে লেখার আশা রাখি।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব