গরম ভাত থেকে ধোঁয়া উঠছে। পাতে এলো আলুভর্তা। পেঁয়াজ-মরিচ আর শর্ষের তেলের অবিমিশ্র ঘ্রাণ। সঙ্গে অর্ধেক ডিমভাজি। টানাটানির সংসারেও ফেলে আসা দিনের ছবি যখন স্মৃতির আয়নায় দেখি, তখন এমনই দৃশ্য ভেসে ওঠে। এখনকার নাগরিক জীবনে এত আয়েশ করে বেঁচে থাকার সময় কোথায়!
ডিম বাঙালির একটি প্রিয় খাবার। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, ধনী, নির্ধন–নির্বিশেষে ডিম বস্তুটি সবার প্রিয় আহার্য। যিনি মেস বাসায় থাকেন, তাঁর হয়তো এক কেজি মাংস বা মাছ কেনার সামর্থ্য নেই, তিনি দোকানে গিয়ে এক হালি ডিম কিনে নিলেন, হয়ে গেল জমাট আহার। শরীরে জুটল প্রয়োজনীয় আমিষ। আবার সামর্থ্য থাকলেও অনেকেই মাছ-মাংস কেনা, এরপর কাটাকুটির ঝামেলায় যেতে চান না। তার জন্য প্রথম বিকল্প ডিম। শুধু ব্যাচেলরদের মেস বাসা বলছি কেন, ছোট–বড় সব পরিবারেই ডিম অতি আদরের সঙ্গে কেনা ও খাওয়া হয়।
এই অতিপ্রয়োজনীয় বস্তুটির দাম হঠাৎ নাগালের বাইরে চলে গেল আগস্টের মাঝামাঝি। ৫ আগস্ট একটি ডিমের দাম ছিল ১২ টাকা। ১০ দিন পরে ১৫ তারিখে সেই ডিমের দাম হলো ১৫ টাকা। ১০ দিনের মধ্যে কী এমন ঘটল যে প্রতি পিসে ৩ টাকা বেড়ে গেল? ডজন ১৪৫ থেকে এক ধাক্কায় ১৮০? আমাদের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন ৪ কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। কেবল ডিমের এমন দাম বাড়ায় দিনে অতিরিক্ত ১২ কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে বেরিয়ে যেতে থাকল।
টিসিবির হিসাব যদি উল্লেখ করি, ২০২১ সালের ৩০ জুলাই এক হালি ডিমের দাম ছিল ২৮ থেকে ৩৩ টাকা। দুই বছর পর ওই একই তারিখে তা গিয়ে পৌঁছাল ৪৮ থেকে ৫০-এ।
এমন অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশে প্রথমবারের মতো অভাবনীয় এক কাণ্ড করে বসল। বেঁধে দেওয়া হলো, ডিমসহ তিন পণ্যের দাম। তাদের কথা, একটা ডিমের উৎপাদন খরচ কিছুতেই সাড়ে ১০ টাকার বেশি না, তাই খুচরোয় ডিম ১২ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। শুরু হয়ে গেল বাজারে অভিযান। অভিযানের সময় সব সাধু সাধু! কর্তারা চলে গেলেই হা হতোস্মি! বেশি দামে কিনে এনে লস দেব নাকি! উৎপাদন পর্যায়ে হস্তক্ষেপ না করে এখানে মরতে আসে কেন? গজরাতে থাকেন ব্যবসায়ীরা।
কাগজে-কলমে অসীম ক্ষমতাধর প্রতিযোগিতা কমিশন পোল্ট্রি শিল্পের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা যে করল, এই মামলা নিষ্পত্তি হবে কবে? ডেইলি স্টার–এর রিপোর্ট বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই প্রতিযোগিতা কমিশন চাল, আটা, ডিম, মুরগির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কারসাজির অভিযোগ এনে ৪৪টি মামলা করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে নিষ্পত্তি করেছে কতটা?
বাণিজ্যমন্ত্রী সজ্জন মানুষ বলে বাজারে প্রচলিত। চেষ্টা তিনি করছেন। তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিযোগিতা কমিশন নামে একটি দপ্তর আছে। এই কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজারসংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা। বাজারে অনৈতিক মুনাফার লোভে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করাও প্রতিযোগিতা আইনের উদ্দেশ্য।
দুঃখজনক হলো, এই নামে যে একটি সরকারি দপ্তর আছে, তা অনেকেই জানে না।
সম্প্রতি এই কমিশনের ঘুম ভেঙেছে। এ দেশের পোলট্রিশিল্পের ‘মা-বাপ’ বলে পরিচিত ১০টি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছে তারা। অভিযোগ, এই কোম্পানিগুলো কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বড় রকমের জরিমানা গুনতে হবে এদের। সেটা হতে পারে তাদের তিন বছরের বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাগজে-কলমে অসীম ক্ষমতাধর এই প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা যে করল, এই মামলা নিষ্পত্তি হবে কবে? ডেইলি স্টার–এর রিপোর্ট বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই প্রতিযোগিতা কমিশন চাল, আটা, ডিম, মুরগির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কারসাজির অভিযোগ এনে ৪৪টি মামলা করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে নিষ্পত্তি করেছে কতটা? ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান স্বয়ং বলছেন, এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই।
প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করেছে ভালো কথা, কিন্তু মামলা নিষ্পত্তিও করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি দিতে হবে। এ রকম দু-একটা উদাহরণ তৈরি করতে না পারলে প্রতিযোগিতা কমিশন নামে যে কিছু একটা আছে, কারও মাথায় থাকবে না।
কোনো কিছু করতে না পেরে সরকার চারটি প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান এক কোটি করে মোট চার কোটি ডিম আমদানি করবে। অর্থাৎ এক দিনের চাহিদার ডিম আসবে দেশে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সংকট হলে কোনো পণ্য অন্য দেশ থেকে আনতে বাধা নেই। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত আমাদের ক্ষুদ্র খামারিদের ক্ষতি করতে পারে। তাঁরা হতাশ হতে পারেন। ইতিমধ্যে এমন কথা উঠেছে।
পোলট্রি ফিড বা মুরগির খাবারের দাম বেশি। বেশি দামে খাবার কিনে অনেক ক্ষুদ্র খামারি পোষাতে পারছেন না। এর ওপর গত গ্রীষ্মে ছিল প্রচণ্ড গরম। অনেক লেয়ার মুরগির খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গত তিন বছরে প্রায় ৬০ হাজার খামার বন্ধ হওয়ার তথ্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মো. মহসীন। খামার বন্ধ হওয়ার কারণে ডিমের সরবরাহ কমে গেছে। অপর দিকে বেড়েছে চাহিদা।
শীতকাল বিদায় নেওয়ার পর পেঁপে বাদে ৬০–৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায়নি বললেই চলে। সবজি কিনতে না পেরে মানুষ ডিম কেনার চেষ্টা করেছে। চাহিদা বাড়ার এটাও একটা কারণ। কিন্তু সেই তুলনায় কমেছে ডিমের উৎপাদন। ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন বার্তায় কাজী ফার্মস দেখিয়েছে, দেশে অব্যাহতভাবে ডিমের উৎপাদন কমছে। কাজী ফার্মসের পরিচালক জিসান হাসান বলেছেন, এক বছরে ডিমের উৎপাদন কমেছে ১৪ শতাংশ।
যাত্রাবাড়ীর মুদি ব্যবসায়ী জহির উদ্দিন মঙ্গলবার বিকেলে জানালেন, তাঁরা পাইকারিতে প্রতিটি ডিম কিনছেন ১২ টাকা ৪০ পয়সা দরে। এক ডজন ডিম বিক্রি করতে একটা পলিব্যাগের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ব্যাগের দাম পড়ে ৩৫ পয়সা। এমন অবস্থায় একটি ডিম ১৩ টাকার কমে তিনি বিক্রি করতে পারছেন না।
কেবল উৎপাদনকারীদের দিকে আঙুল তুলে ফল হবে বলে মনে হয় না। মুরগির খাবারের দাম কমানোর উপায় বের করতে হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে মুরগির পুষ্টিকর খাবার উদ্ভাবন করতে হবে। ভিটামিনসমৃদ্ধ এমন খাবার যা পরিমাণে কম লাগবে, কিন্তু পুষ্টির চাহিদা মেটাবে।
বাড়াতে হবে ডিমের উৎপাদন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেবল করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে মাঠপর্যায়েও দৃষ্টি দিতে হবে। ছোট ও মাঝারি আকারের খামারিরা আরও কীভাবে প্রণোদনা পেতে পারে, সে জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। আপাতত ডিম আমদানির সিদ্ধান্তটা সাময়িক হোক। কারণ, অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চাকরি না করে তাঁরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা যেন কোনো ভুল বার্তা না পান।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
alim.zaman@prothomalo.com