ইডেনে ছাত্রলীগের ‘পারফরমেন্সে’ আমরা কি মুগ্ধ হবো না

গতকাল রবিবার রাজধানীতে ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গোটা জাতি ফুটবলের মেয়েদের নিয়ে এ কয়েক দিন মেতে ছিল। সামাজিক নানা বাধা বা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ঠেলে মেয়েদের এগিয়ে যেতে নারী ফুটবলারদের এই সাফল্যের চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে। কিন্তু সেই অনুপ্রেরণার ‘বেলুনে সুই ফোটানোর’ মতোই যেন হাজির হলেন ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের নেত্রী-কর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় দিনই নানা অপকর্ম দিয়ে খবরের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ। সেদিক দিয়ে কলেজগুলোর ছাত্রলীগ শাখা অনেকটা পিছিয়ে আছেই বলা যায়। সিলেটে এমসি কলেজ, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজ, রাজধানীতে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নানা সময়ের ‘প্রচেষ্টা’ আমরা দেখি। ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা হয়তো ভেবেছেন তাঁরা কেন পিছিয়ে থাকবেন!

শুধু রাজধানীই নয়, গোটা দেশের স্বনামধন্য মহিলা কলেজ হচ্ছে ইডেন। পিছিয়ে থাকার দায় সেখানকার ছাত্রলীগ নেত্রীরা আগে থেকেই অনুধাবন করতে পারছিলেন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কলেজ ছাত্রলীগকে ছাপিয়ে যেতে বেশ কিছুদিন ধরে যেন নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তাঁরা। কয়েক দিন পরপর সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবরও হচ্ছিলেন। তবে আমাদের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ রাজনীতিতে তাঁরা খুব মনোযোগ পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই যেন সরাসরি মাঠে নেমে পড়লেন তাঁরা! বিষয়টি এমন না যে ছেলেরা মারামারি করতে পারলে মেয়েরাও কেন পারবে না। মূলত একটি কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডই এখানে মুখ্য, সেটি পুরুষ বা মহিলা কলেজ যেটিই হোক।

গত রোববার ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনা ইতিমধ্যে সবারই জানা হয়ে গেছে। সব কটি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের, এমনকি পুলিশকেও ইডেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই মারামারিকে ‘চুলোচুলি’ বলে হাস্যরস তৈরি করা হয়েছে। এ নিয়ে মিম আর ট্রলেরও শেষ নেই। ‘চুলোচুলির’ সেই ভিডিওতে কেউ কোনো এক কোম্পানির চুল মজবুত করার নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলও যুক্ত করে দিয়েছেন।

ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বাঁশ, স্ট্যাম্প, লাঠি বা ধারালো অস্ত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত হলেও ইডেনের মেয়েদের হাতে আমরা দেখি প্লাস্টিকের টুল বা চেয়ার। কোনো প্লাস্টিক পণ্যের কোম্পানি বিষয়টিকে বিজ্ঞাপন হিসেবে চালিয়ে দিলে মন্দ হয় না। স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করতে পারে—‘নিরাপদ মারামারির জন্য আমাদের মজবুত পণ্য ব্যবহার করুন। চেয়ারও ভাঙবে না, মাথাও ফাটবে না।’

তবে ইডেনের এই মারামারি বা চুলোচুলিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলা-উপজেলা বা অন্যান্য শাখার কমিটিতে দেখা যায়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রতিপক্ষ হয়ে নিজেদের অনুসারী নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। সেদিক দিয়ে ‘অভূতপূর্ব’ ঘটনা ঘটেছেই বলা যায় ইডেনে। সেখানে ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রীভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা একজোট মানে ‘ঐক্যবদ্ধ’। তাঁদের প্রতিপক্ষ হচ্ছেন, সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসসহ ২৫ জন নেত্রী ও তাঁদের অনুসারীরা। তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের ‘এক সমুদ্র’ অভিযোগ।

অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, দিনের পর দিন এত গুরুতর অভিযোগ থাকলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গতকালের মারামারিতেও তাঁদের পক্ষ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তামান্না ও রাজিয়ার প্রতিপক্ষ নেত্রীদের গণবহিষ্কার করেছে, যেখানে সাংগঠনিক কোনো নীতি ও নিয়মই মানা হয়নি। মারামারি করল দুই পক্ষ আর শাস্তি পেল এক পক্ষ, বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধও।

সিট–বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে তামান্না কেমন ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে উঠেছিলেন, সেটি প্রকাশ পায় তাঁর অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়া থেকে। গত আগস্টে তামান্না কলেজের হলের এক রুমে ছাত্রীদের এভাবে হুমকি দিচ্ছেন, ‘বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু।...কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা (হল প্রশাসন) দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের? কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস?’ (প্রথম আলো, ২০ আগস্ট)।

এই অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ায় দুই ছাত্রীকে মানসিক নির্যাতন করে আবারও খবর হন তিনি। নির্যাতনের একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে সেই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল করার হুমকিও দেন তিনি (প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট)।

তামান্নাসহ শীর্ষ নেত্রীদের বিরুদ্ধে ক্যানটিনের চাঁদাবাজি, ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে চাঁদাবাজি, কলেজের মুদিদোকানে চাঁদাবাজির চেয়েও ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে—বিভিন্নভাবে ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব দেওয়া।

গতকাল সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া ইডেনের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তারের (বৈশাখী) একটি বক্তব্য ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। যেখানে তিনি বলছেন, সুন্দরী মেয়েদের রুমে ডেকে নিয়ে জোর করে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো ব্যবহার করে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করতে তাঁদের বাধ্য করা হয়।

আজ সোমবার কলেজে এক সংবাদ সম্মেলনে সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলছেন, ‘আমাদের কানে বারবার আসে যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাঁদের (তামান্না ও রাজিয়া) মেয়েরা নাকি কাজ নিয়ে আসে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করে...’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২৬ সেপ্টেম্বর)।

একটি মহিলা কলেজে ছাত্ররাজনীতির নামে আসলে কী ঘটছে এবং সেখানকার সাধারণ ছাত্রীরা কীভাবে এর ভুক্তভোগী হচ্ছে, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে ছাত্রলীগের ভেতর থেকেই ওঠা এসব বক্তব্য।

অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, দিনের পর দিন এসব অভিযোগ থাকলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গতকালের মারামারিতেও তাঁদের পক্ষ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তামান্না ও রাজিয়ার প্রতিপক্ষ নেত্রীদের গণবহিষ্কার করেছে, যেখানে সাংগঠনিক কোনো নীতি ও নিয়মই মানা হয়নি। মারামারি করল দুই পক্ষ আর শাস্তি পেল এক পক্ষ, বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধও।

অন্যদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ ও অধ্যক্ষের আচরণ দেখলে মনে হয়, তাঁরাও বুঝি মেনে নিয়েছে তামান্না ও রাজিয়াই কলেজটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর। তাঁরাই সেখানে নমস্য! একটি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে, ইডেন কলেজের ছয়টি হলের সিটভাড়া দিয়ে তামান্না মাসে পাঁচ লাখ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা আয় করেন। এত কিছুর পরেও যখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও কলেজ প্রশাসন তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কলেজ ঘিরে এত এত বাণিজ্যের ভাগ কি তারাও পায়?

তবে দুর্মুখেরা বলতে পারেন, তামান্না ও রাজিয়া এখানে নির্বুদ্ধিতাই করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, সিট–বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির ভাগ থেকে কমিটির অন্য নেত্রীদের বঞ্চিত করছিলেন তাঁরা। এ জন্য হয়তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ‘বিদ্রোহ’ করেন অন্য নেত্রীরা, সেই সঙ্গে এই মারামারি বা চুলোচুলিও। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে আনন্দ মিছিলও হয়েছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে ইডেন ছাত্রলীগ ‘গর্ব’ করে বলতে পারে যে আমরাও দেখিয়ে দিলাম! দিন শেষে তো সেটিই মনে রাখবে মানুষ। তাই নয় কি?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক