নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত শাওন প্রধানের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে। বিএনপি বলেছে, তিনি যুবদলের কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগ বলছে, তিনি যুবলীগ করতেন। জীবিত থাকতে কারখানার ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি শাওনের খোঁজ কেউ নিয়েছেন বলে জানা নেই। এখন মৃত্যুর পর দুই দলই নিজেদের কর্মী বলে দাবি করছে। একেই বলে রাজনীতির খেলা।
১ সেপ্টেম্বর ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপি সারা দেশে যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, সরকারের পক্ষ থেকে তার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। রাজধানী ঢাকাসহ বহু জায়গায় বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মিছিল করেছে।
রাজধানীতে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের বাধা দেয়নি। এটাকে আমরা সরকারের গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা বলে মেনে নিতে পারি। প্রশ্ন হলো, সরকার ঢাকায় যে সহিষ্ণুতা দেখাল, নারায়ণগঞ্জে সেটা হলো না কেন?
কেন সেখানে যানজটের দোহাই দিয়ে বিএনপির মিছিলে পুলিশ বাধা দিল এবং শাওন প্রধান নামের এক তরুণ গুলি খেয়ে মারা গেলেন। দিন কয়েক আগে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমান যে পুরো শহর অচল করে সমাবেশ করলেন, সে সময় পুলিশ কিছু বলল না। অথচ গতকাল বিএনপি মিছিল শুরু করতেই পুলিশ বাধা দিল। এর প্রত্যুত্তরে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ইটপাটকেল ছুড়লেন। সংঘর্ষ বাধল। সে ক্ষেত্রে উসকানিটা কাদের কাছ থেকে এসেছে, সহজেই ধারণা করা যায়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বিএনপি আয়োজিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অন্তত ৩৭টি কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন অথবা পুলিশ বাধা দিয়েছে। ভোলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেখানেও গুলিতে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুজন নেতা-কর্মী মারা যান। লক্ষ্মীপুরে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বাড়িতে এবং বরিশালের গৌরনদীতে স্থানীয় বিএনপি ও যুবদল নেতাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, তিনি আওয়ামী লীগারদের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার। তিনি মিছিলে বাধা দেওয়ার যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি বিনা অনুমতিতে রাস্তা আটকে রেখে মিছিল-সমাবেশ করছিল।’ শামীম ওসমান যেদিন সমাবেশ করার নামে পুরো শহর অচল করে দিয়েছিলেন, সেদিন তঁারা কোথায় ছিলেন?
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে শোভাযাত্রা করতে দলীয় নেতা-কর্মীরা আলী আহম্মদ চুনকা পাঠাগারের সামনে সমবেত হন। সাড়ে ১০টার দিকে শোভাযাত্রায় বাধা দেয় পুলিশ।
এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এর জবাবে পুলিশ তাঁদের ওপর লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলি ছোড়ে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, পুলিশ অতর্কিতে তাঁদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করেছে এবং এতে যুবদলের কর্মী শাওন প্রধান নিহত হন। (প্রথম আলো, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২)
বহু বছর আগে দেখেছি হরতাল-অবরোধে কেউ মারা গেলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয়ে তাঁকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করত। নারায়ণগঞ্জে শাওন প্রধানের ঘটনায় সে রকমটি ঘটেছে। মিছিলটি ছিল বিএনপির। সেখানে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কোনো কর্মী একেবারে সামনের সারিতে থাকবেন, এটা অবিশ্বাস্য।
শাওনের চাচা শওকত আলী ফতুল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। চাচা আওয়ামী লীগ নেতা হলেই ভাতিজা যুবলীগ করবেন, এ রকম কোনো দিব্যি নেই। আমাদের দেশে বাবা ও ছেলে, স্বামী-স্ত্রীও ভিন্ন দল করার অনেক উদাহরণ আছে।
শাওন প্রধান পুলিশের গুলিতে মারা যান বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে যুবলীগ কর্মী দাবি করে তাঁর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে একদল নেতা-কর্মী অংশ নেন। পরে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘শাওন ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলীর চাচাতো ভাতিজা। শাওন যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
আমরা জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। শাওন প্রধান যে দলেরই হোন না কেন, হত্যার বিচার হওয়া উচিত। আশা করব, আওয়ামী লীগের যে নেতারা শাওন হত্যার বিচার চাইছেন, তঁারা অন্তত থানায় গিয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করবেন।
সমস্যা হলো পুলিশ সুপার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শাওন প্রধানকে যুবদলের কর্মী নয় বলে সনদ দিলেও তাঁর চাচা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেছেন ভিন্ন কথা। তাঁর মতে, সে কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। আবার এ–ও বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া যুবদলের মিছিলে সামনের সারিতে থাকা শাওনের ছবি দেখালে শওকত আলী ছবিটি শাওনের বলে শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ছবিতে শাওনকে দেখা যাচ্ছে। এই ছবি তো মুছে ফেলা যাবে না।’
আওয়ামী লীগ নেতারা যেই শাওন হত্যার বিচার চাইলেন, সেই শাওনকেই দাফন করা হলো রাতের অন্ধকারে পুলিশের উপস্থিতিতে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া একটায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়। হস্তান্তরের পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে তড়িঘড়ি করে শাওনের লাশ দাফন করা হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পুলিশের উপস্থিতিতে নিহত শাওনের বড় ভাই মিলন প্রধান ও মামা মোতাহার হোসেনের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পাহারায় শাওনের লাশ বাড়িতে নেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ নেতারা একটি সত্য আড়াল করতে গিয়ে অনেকগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।
কেবল নারায়ণগঞ্জ নয়, ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির মিছিলে বাধা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নাটোরে। অনেক স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও হামলা করেছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিএনপির এক নেতার বসতবাড়ি ভাঙচুর ও যুবদল নেতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক দেওয়ান মো. জুয়েলের মালিকানাধীন একটি ওয়ার্কশপে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান। এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার রূপগঞ্জে কাঞ্চন পৌরসভায় বিএনপির তিন নেতার বাড়িতে ও যুবদলের এক নেতার রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনা ঘটে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বিএনপি আয়োজিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অন্তত ৩৭টি কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন অথবা পুলিশ বাধা দিয়েছে। ভোলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেখানেও গুলিতে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুজন নেতা-কর্মী মারা যান। লক্ষ্মীপুরে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বাড়িতে এবং বরিশালের গৌরনদীতে স্থানীয় বিএনপি ও যুবদল নেতাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
এসব হামলা কী প্রমাণ করে? মহা প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ কি ভয় পেয়ে গেছে? আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায়ই বলেন, খেলা হবে। কার কত জনপ্রিয়তা আছে, সেটি প্রমাণ করতে রাজনৈতিক দলগুলো সভা–সমাবেশ ডেকে জনগণের সামনে নিজেদের সাফল্যের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তুলে ধরে। এটাই রাজনীতির খেলা। কিন্তু এখন তো আওয়ামী লীগের নেতারাই খেলার নিয়ম মানছেন না।
একদিকে বিএনপির মিছিল-সমাবেশে পুলিশের বাধা, আরেক দিকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে অফিসে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের চড়াও হওয়ার ঘটনা কী প্রমাণ করে? আওয়ামী লীগ কি বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে চায়; না বিএনপি নির্বাচনে না এলে তাদের সুবিধা—সেই বার্তাই এভাবে দেশবাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি sohrabhassan55@gmail.com