মতামত

ধর্ষণ, ক্ষমতার রাজনীতি ও বোকামির মূল্য

কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী আর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মধ্যবাগ্যা গ্রামে ঘটনার মধ্যে আছে শুধু সময়ের ফারাক। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মধ্যবাগ্যা এলাকায় স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে এক নারীকে মারধর ও দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, ওই নারী ‘বেয়াদবি’ করেছিলেন। ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দেননি তিনি। এ তো অনেক বড় অপমান! গরিব এক সামান্য নারীর এই অসামান্য সাহস আসে কোথা থেকে? এসবের ‘উচিত সাজা’ হিসেবে ওই হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

ভোটের রাত বলেই হোক বা অন্য কোনো অজানা কারণেই হোক, ঘটনাটি তখন দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। নির্যাতিতার স্বামী থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি করতে নানা বাধার সম্মুখীন হলে সেটাও প্রচার পায়। অনেক বাঁক পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা রুজু হয়। ঘটনার খোসা ছাড়াতে গিয়ে দেখা যায়, ভোটকেন্দ্রের পাহারায় থাকা সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও ইউপি সদস্য রুহুল আমিন তাঁর দলবল নিয়ে ধর্ষণের উদ্দেশ্যেই হামলা করেছিলেন নারীর বাড়িতে।

মাঠ ফাঁকা বলেই অপরাধ, নির্যাতন করেও যে কেউ তখত-ই-তাউসে পৌঁছে যাবে বলে মনে করলে তাঁরা নিতান্তই বোকার মুলা খাচ্ছেন

ক্ষমতায় তখন কর্তৃত্ববাদী সরকার। তাদের সেই প্রতারণামূলক আপ্তবাক্য, ‘অপরাধী যে–ই হোক, কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না, আইন তার নিজের গতিতে চলবে’ প্রচার হতে থাকল টক শো আর মিডিয়া শোতে।

বলা বাহুল্য, তঁারা এখন চেয়ারে নেই। চেয়ার দখলের দৌড়ে যাঁরা এগিয়ে আছেন, এখন তাঁদের প্রতাপ দেখানোর সময় বৈকি! মহারাষ্ট্র থেকে বাংলা লুট করতে আসা বর্গিরা অবাধে ধর্ষণ করেছে। হানাদার পাকিস্তানিরা আর তাদের দোসররাও দখলদারত্বকে পাকাপোক্ত করার অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে এগিয়ে রেখেছিল। তারা চলে গেলেও মুক্ত বাংলায় ধর্ষণ আর নারীর অসম্মান কি এক দিনের জন্যও বন্ধ ছিল?

মুক্ত বাংলাদেশের প্রথম শহীদ দিবসের কথা অনেকেরই মনে থাকবে। সেদিন ঢাকার শহীদ মিনারে মধ্যরাতে পরিকল্পিতভাবে বাতি নিভিয়ে যা হয়েছিল, তার বিচার কোনো দিন হয়নি। আরও পরে বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের অসম্মান করাকে তদানীন্তন পুলিশপ্রধান প্রকাশ্যে আশকারা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তরুণেরা একটু দুষ্টামি করেছে।’

এখন প্রতাপ প্রতিষ্ঠায় মরিয়ারা একই পথে হাঁটছেন। সুবর্ণচরের ঘটনার ছয় বছর পর গত ২০ অক্টোবর দিবাগত রাতে কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহীতে প্রায় একই কায়দায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে থাকা দলের সদস্যরা।

আবদুল মতিন ওরফে তোতা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততার কথা কারও অজানা নয়। বিএনপির চর এলাহী শাখার সাবেক সভাপতির ছেলে ইব্রাহিমসহ ছয়জনের নাম এসেছে এই ধর্ষণ ঘটনার আসামি হিসেবে। আসামি ইব্রাহিমের বড় ভাই মো. ইসমাইল ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি। জানা যাচ্ছে, আসামিরা যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। হতে পারে ইব্রাহিম ছেলে ভালো! বিপক্ষের লোকেরা ষড়যন্ত্র করে ভালো ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে! আলামত কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

ধর্ষণের ঘটনা কাউকে জানালে হত্যা করা হবে—এমন হুমকি দিয়ে গেলেও ভুক্তভোগীরা ঘটনার পরদিন সকালে বিষয়টি স্থানীয় সমাজপতিদের জানান এবং বিচার চান। তাঁরা বিচারের নামে টালবাহানা করতে থাকেন। পরে ২৫ অক্টোবর বিকেলে স্থানীয় চর বালুয়া পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে পুলিশের কাছে মৌখিক অভিযোগ করলে পুলিশ তাঁদের কোম্পানীগঞ্জ থানায় পাঠায়।

২৬ অক্টোবর রাতে এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ চারজন অভিযুক্তকে আটক করেছে। বলা বাহুল্য, মূল আসামিকে পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না, তবে চেষ্টা জারি আছে। অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্তদের হুমকিধমকি জোরদার হয়েছে।

মাঠ ফাঁকা বলেই অপরাধ, নির্যাতন করেও যে কেউ তখত-ই-তাউসে পৌঁছে যাবে বলে মনে করলে তাঁরা নিতান্তই বোকার মুলা খাচ্ছেন। এই মুলা মুখে নিয়েই ’৭২–এর ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকার শহীদ মিনারে ছাত্রলীগ যে তাণ্ডব দেখিয়েছিল, তার ফল হাতে হাতে পেয়েছিল পরবর্তী ডাকসুসহ দেশের সব ছাত্র সংসদ নির্বাচনে।

মানুষ অনেক কিছু ভুলতে পারে কিন্তু অপমান, অসম্মান, সম্ভ্রমহানি ভুলতে পারে না, ভোলেনি।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

    wahragawher@gmail.com