দালাই লামা
দালাই লামা

মতামত

পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, সেটি কেন ঠিক করতে চায় চীন

তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা হাঁটুর চিকিৎসায় এখন যুক্তরাষ্ট্রে। বয়সজনিত ও শারীরিক কারণে তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা নিয়ে উদ্বেগ তীব্র হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতিরা যখন ৮৮ বছর বয়সী তেনজিন গায়সোর (১৪তম দালাই লামা) দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনা করছেন, ঠিক তখন চীন অধীর আগ্রহে তাঁর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, যাতে তাঁর জায়গায় তাদের আজ্ঞাবহ একটি পুতুল উত্তরাধিকারী বসিয়ে দেওয়া যায়। 

তিব্বতিরা দালাই লামাকে বুদ্ধের জীবন্ত অবতার বলে মনে করেন। ১৩৯১ সাল থেকে দালাই লামা ১৩ বার ‘পুনর্জন্ম’ পেয়েছেন। যখন একজন দালাই লামা মারা যান, তখন পরবর্তী দালাই লামার জন্য অনুসন্ধান শুরু হয়। প্রয়াত দালাই লামার প্রধান শিষ্যরা বিভিন্ন শাস্ত্রীয় লক্ষণ ও দর্শনের ভিত্তিতে নতুন দালাই লামা কে হবেন, তা ঠিক করেন।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার জোর দিয়ে বলে আসছে, পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, তা শনাক্ত করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। আর কারও নয়। চীন যে এই প্রথম তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের কোনো নেতা নির্ধারণ করতে চাইছে, তা নয়। 

আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের দিক থেকে দালাই লামার পরই যাঁর অবস্থান, সেই পঞ্চেন লামা (দালাই লামার মতো পঞ্চেন লামাও একটি পদবি) হিসেবে ছয় বছর বয়সী এক বালককে দালাই লামা সত্যায়ন করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে চীন সরকার সেই পঞ্চেন লামাকে অপহরণ করেছিল। এরপর চীন সরকার নিজেদের পছন্দমাফিক একজনকে পঞ্চেন লামা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। বালক বয়সে অপহৃত হওয়া প্রকৃত পঞ্চেন লামা আজ প্রায় তিন দশক ধরে চীনের কারাগারে বন্দী। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় কারাগারে থাকা রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে তিনি একজন। 

তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের তৃতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও তিব্বতের কর্ম কাগ্যু সম্প্রদায়ের প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা কর্মপা শনাক্তকরণেও চীনা হস্তক্ষেপের নজির আছে। তিব্বতের কর্মপা ওগিয়েন ত্রিনলে দোরজে ১৯৯৯ সালে হঠাৎ করে কিছু সঙ্গীসাথিসহ নেপাল হয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। ১৪ বছর বয়সী কর্মপার অতি সহজে চীন থেকে পালিয়ে আসাটা ভারতীয়দের মধ্যে সন্দেহের জন্ম দিয়েছিল। ২০১১ সালে দিল্লি পুলিশ তাঁর বাসস্থল থেকে বিপুল পরিমাণে চীনা মুদ্রা জব্দ করার পর অনেকেই তাঁকে চীনের চর বলে সন্দেহ করতে থাকেন।

দালাই লামা শুধু তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রবাসী তিব্বতি সরকারের হাতে তুলে দেননি; তিনি এই ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন যে তিনি পুনর্জন্ম না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। অর্থাৎ তিনি যদি ঘোষণা দেন তিনি মানবজীবন নিয়ে পুনর্জন্ম নেবেন না, তাহলে তার মানে দাঁড়াবে, তিনিই হবেন সর্বশেষ দালাই লামা। তাঁর পরে আর কোনো দালাই লামা আসবেন না। আর সেটি হবে তাঁর এমন এক সিদ্ধান্ত, যা চীনের ঠিক করা যেকোনো দালাই লামার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করবে। 

অনেকের সন্দেহ, ওগিয়েন ত্রিনলে দোরজে আদতে ভারতে পালিয়ে আসেননি, চীন সরকারই পালিয়ে যাওয়ার নাটক সাজিয়ে তাঁকে চর হিসেবে ভারতে পাঠিয়েছে। তাঁর ওপর ভারত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ২০১৮ সালে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চীনের দ্বারা অভিষিক্ত এই কর্মাপাকে তাঁর সম্প্রদায়ের বৈধ প্রধান হিসেবে আর স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। 

তবে দালাই লামার বিষয়টি চীনের কাছে একেবারে আলাদা। এই পদ চীনের কাছে মহামূল্যবান ‘ধবল তিমি’। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া তেনজিন গায়সোরকে ১৯৩৭ সালে মাত্র দুই বছর বয়সে ১৪তম দালাই লামা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল।

১৯৫১ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেওয়ার পর থেকে সেই দালাই লামা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) পথের কাঁটা হয়ে আছেন। ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত দালাই লামা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে চীনা দখলদারির বিরুদ্ধে তিব্বতীয় প্রতিরোধকে মূর্ত করে তোলেন। 

আগে দালাই লামা তিব্বতের শুধু আধ্যাত্মিক নেতাই ছিলেন না, ভূখণ্ডটির রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন। অনেকটা ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ও একজন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মিশেলে তিনি ক্ষমতায়িত ছিলেন। তবে ২০১১ সালে প্রবাসী তিব্বতি সরকারের হাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এই প্রবাসী সরকার ভারতে ও অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী তিব্বতি শরণার্থীদের দ্বারা পাঁচ বছর পরপর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকে। 

দালাই লামা শুধু তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রবাসী তিব্বতি সরকারের হাতে তুলে দেননি; তিনি এই ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন যে তিনি পুনর্জন্ম না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। অর্থাৎ তিনি যদি ঘোষণা দেন তিনি মানবজীবন নিয়ে পুনর্জন্ম নেবেন না, তাহলে তার মানে দাঁড়াবে, তিনিই হবেন সর্বশেষ দালাই লামা। তাঁর পরে আর কোনো দালাই লামা আসবেন না। আর সেটি হবে তাঁর এমন এক সিদ্ধান্ত, যা চীনের ঠিক করা যেকোনো দালাই লামার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করবে।

দালাই লামা ভালো করে জানেন, কোনো দালাই লামা না থাকার তুলনায় সিপিসির অনুগত একজন দালাই লামা চীনের জন্য অনেক বেশি কাজের হবে এবং তিব্বতের জন্য অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হবে।

প্রোস্টেট ক্যানসারের জন্য ২০১৬ সালে দালাই লামার দেহে রেডিও থেরাপি দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ক্যানসার থেকে তিনি ‘পুরোপুরি’ সেরে উঠেছেন, তবে হাঁটুর সমস্যার সঙ্গে তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। 

দালাই লামার অবস্থান ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে তাঁর বহির্বিশ্ব ভ্রমণের সূচি সংকুচিত হওয়া কাজ করেছে। চীনা চাপের মুখে পড়ে ইউরোপীয় গণতন্ত্র এবং এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোসহ (জাপান ছাড়া) বেশির ভাগ দেশ তাঁকে ভিসা দিতে চায় না। তবে কপাল ভালো, যুক্তরাষ্ট্র দালাই লামাকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এবং ভারত বুক ফুলিয়ে ৬৫ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে দালাই লামাকে তার ‘সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় অতিথি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তিনিও নিজেকে ‘ভারতের পুত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে তিব্বত ছাড়তে বাধ্য হওয়া লোকদের সবচেয়ে বড় সংখ্যক লোককে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। এই শরণার্থী তিব্বতিদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও তিব্বতি ভাষায় পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোকে সহায়তা দিয়ে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অন্যদিকে চীন তিব্বতের সংস্কৃতি এবং পরিচয় ধ্বংস করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে সি চিন পিং প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসার পর থেকে তিব্বতিদের পরিচয়, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

পরবর্তী দালাই লামাকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে চীনের ছক নস্যাৎ করে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এক হয়ে কাজ করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ভালো খবর হলো, আমেরিকা ইতিমধ্যে ‘তিব্বতিয়ান পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করেছে এবং ২০২০ সাল থেকে সেটি কার্যকরও হয়েছে। ওই আইনে বলা হয়েছে, ‘১৫তম দালাই লামা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ১৪তম দালাই লামার লিখিত অসিয়তনামাকে মূল নির্ধারক হিসেবে ধরা হবে। এই আইনে তিব্বতের বৌদ্ধ উত্তরাধিকার অনুশীলনে হস্তক্ষেপকারী চীনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বানও জানানো হয়েছে। 

তবে এটুকু যথেষ্ট নয়। আরও করণীয় আছে। দালাই লামা নামক ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করতে চীন যে চক্রান্ত করছে, তা নস্যাৎ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে বহুপক্ষীয় কৌশল প্রণয়নে একযোগে কাজ করা দরকার। 

 ● ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ