মতামত

ঈদযাত্রা, পাল্টে যাওয়া গ্রাম আর উত্তপ্ত দিন

এ দেশে ঈদযাত্রার ভোগান্তি বুঝি কখনো ফুরাবে না
ফাইল ছবি

প্রতিবছর যাঁরা ঈদে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ছোটেন, আমিও তাঁদের মধ্য পড়ি। আগে গাবতলী থেকে বাসে যেতাম। বলা সংগত, বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় আমার বাড়ি। ব্যাগ-বোঁচকা দারা-পরিবার নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাস কাউন্টার হাজির হয়ে অনির্দিষ্টকালব্যাপী সেই যাত্রার অভিজ্ঞতা অন্যদের মতো আমারও চিরস্মরণীয়। বছর দশেক হলো প্রথম আলো আমাকে একটি মোটরগাড়ি দেওয়ায় গণপরিবহনে উঠতে হয় না। কিন্তু যাত্রাপথের কালক্ষেপণ অতি বিরল দু–একবারের ব্যতিক্রম ছাড়া একই আছে।

এমনও হয়েছে, ঈদের আগের দিনে সকাল ছটায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বাড়িতে পৌঁছতে রাত দুইটা বেজেছে। সময়ের রেকর্ড হয়েছিল ২০১৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতরে। সেবার রওনা দিতে একটু দেরি হলো, সকাল নয়টা বেজেছিল সম্ভবত। ইফতার করলাম যমুনা সেতুর ওপর আটকে থাকা অবস্থায়। বাড়ি গিয়ে শুনি মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে।

যে বিরল ব্যতিক্রমের কথা বললাম, তা এবার হলো। ঈদের ছুটি শুরু হয়েছিল শনিবার থাকে। আমি ঢাকা ছাড়ি বৃহস্পতিবার সকাল আটটায়। আগাম রওনা দেওয়ায় বেশ উপভোগ্য হলো যাত্রাপথ। ‘যাত্রাপথ’ বললাম, কারণ এই পথ নিয়েই যত বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ, দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর শোকও।

বৃহস্পতিবার সকালে গাবতলী টার্মিনাল আর হাটের সংযোগ মোড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো ছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা পশুবোঝাই ট্রাকগুলো সারিবদ্ধ থেকে হাটে প্রবেশের কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সভার বাসস্ট্যান্ডের উভয় পাশ থেকে বেশ খানিকটা দূর অবদি লোকাল গাড়ির জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, গাবতলী ও সাভারের অতি খ্যাতিমান যানজট ও বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ল না। অনায়াসে নবীনগর পর্যন্ত আসা গেল।

বিশৃঙ্খলার আলামত মিলল নবীনগর মোড় থেকে। ঢাকা শহর ছাড়া দেশে এখন আর কোথাও প্যাডেল রিকশা চলে না। ব্যাটারি ও মোটর যুক্ত করে রিকশা এখন মোটরগাড়িতে পদোন্নতি পেয়েছে (ঢাকাতেও এখন ট্রাফিক পুলিশের সস্নেহ প্রশ্রয়ে এমন রিকশার প্রাদুর্ভাব যথেষ্ট)। কাজেই মহাসড়কে তারাও ছুটছে তুফানগতিতে। গগনস্পর্শী তাদের স্বাধীনতা। চন্দ্রা থেকে নবীনগর মোড় পর্যন্ত সড়কে ব্যাটারিচালিক শত শত রিকশাভ্যান চলছে সোজাসুজি এবং বিপরীত দুদিকেই। অর্থাৎ সড়কের কিনারা দিয়ে এক পাশেই রিকশাভ্যানের দুটি লাইন। তাদের আটকানোর কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণহীন, মুক্ত, স্বাধীন এসব রিকশাভ্যানকে সসম্মানে পথ করে দিয়ে মোটরগাড়ি যাচ্ছে প্রায় সড়ক বিভাজক ঘেঁষে। এর মধ্যে আবার মোটরসাইকেলগুলো ছুটছে ফাঁকফোকর গলিয়ে। কিছু মোটরসাইকেলচালক ছুটছেন সপরিবার। অনেকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন। মহাসড়কের এহেন দৃশ্য যাঁরা আগে কখনো দেখেননি, তাঁদের মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক, সড়ক দুর্ঘটনা ঘণ্টায় ঘণ্টায় না ঘটে, মাঝেমধ্যে ঘটে, এ-ই তো বড় সৌভাগ্যের বিষয়!

চন্দ্রা থেকে যমুনা সেতুর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত চার লেনের নতুন মহাসড়ক। সত্যি অসাধারণ! যেন হাওয়ায় ভেসে এলাম এলেঙ্গা পর্যন্ত। তারপর থমকে দাঁড়ানো। সড়কের দুই পাশজুড়ে এলেঙ্গা বাজার। হরেক পণ্যের পসরা, দোকানপাট, লোকাল বাস, স্কুটার, রিকশা, ভ্যানের বিপুল সমাবেশ। পথ থেকে একটু সরে দাঁড়ালে বা পসরা বসালেও কেনাবেচায় ঘাটতি হবে না, যাত্রীও কমতি হওয়ার নয়। কিন্তু এই একটু সরে যেতে রাজি নয় কেউ। সড়কের ওপর পণ্যের পসরা নিয়ে চেপে না বসলে যেন হাটবাজারের মর্যাদা বানে ভেসে যাবে। কেবল এলেঙ্গার দোষ ধরে লাভ নেই, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই এ অবস্থা।

আইন আছে, নিয়ম আছে, কিন্তু কেউ মানে না। মানানোর ব্যবস্থাও নেই। শুধু সড়ক সচল রাখার ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্র গা ছাড়া, দায়সারা ভাব। এটাই দেশের চালু রীতি। এটাই বাস্তবতা।

ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশের অবশ্য দেখা পাওয়া গেল। পথের পাশে দাঁড়িয়ে। পুলিস সদস্যদের কেউ কেউ দায়সারাভাবে সড়ক মুক্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। তাই একেবারে স্থবির হয়ে থাকতে হলো না। পা টিপে টিপে চলার মতো করে এলেঙ্গা বাজার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া গেল। অন্যদের এ পরিত্রাণ এত সহজ হবে না। ঈদের ঐতিহ্যবাহী যানজটের উন্মেষকাল দেখে যমুনা সেতুতে উঠলাম। দুপুর ১২ টা নাগাদ, অর্থাৎ ঘণ্টা চারেকের মধ্যে বাড়ি পৌছালাম। সন্ধ্যায় খবর এল, এলেঙ্গা থেকে সেই যানজট লেগে গেছে। পরের কাহিনি সবাই জানেন।

বক্তব্য সহজ। এককভাবে কারও প্রতি অভিযোগ করার কিছু নেই। আইন আছে, নিয়ম আছে, কিন্তু কেউ মানে না। মানানোর ব্যবস্থাও নেই। শুধু সড়ক সচল রাখার ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্র গা ছাড়া, দায়সারা ভাব। এটাই দেশের চালু রীতি। এটাই বাস্তবতা।

দুই.

ঈদের অভিজ্ঞতা মিশ্র। এবার পাবনার বেড়া উপজেলায় শ্বশুরবাড়ি এবং শেরপুরে মিলিয়ে ঈদের ছুটি কাটালাম। আমার মা–বাবা প্রয়াত, শ্বশুরও। বৃদ্ধা শাশুড়ি আছেন। অনেক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শ্যালিকারা এসেছিলেন। সবাই মিলে বেশ আনন্দ হলো। তবু মিশ্র অভিজ্ঞাত বলার কারণ, একে অসহ্য গরম, উপরন্তু যখন-তখন লোডশেডিং স্বস্তিটুকুও নিংড়ে নিল। পাবনা-বগুড়া, দুই জায়গাতেই বিদ্যুতের একই অবস্থা। ‘কতবার যে নিবল বাতি’, তার ইয়ত্তা নেই। ঘেমে ভিজে, গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে বাচ্চাকাচ্চারা খুকখুক কাশি দিতে শুরু করল। বড়দেরও কেউ কেউ গলা মেলালেন। ঈদের জামাতে এসে খতিবের বয়ানের সঙ্গে যুক্ত হলো মুসল্লিদের হাঁচি-কাশির ঐকতান। অচিরাৎ ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দির খবর কানে এল। তবে লোকের মধ্যে করোনা নিয়ে আর তেমন উদ্বেগ-আতঙ্ক নেই। জ্বর-সর্দি হলে পরীক্ষাও করাতে যাচ্ছেন না। মাস্ক ব্যবহারেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বিজয়ী জাতি, তাই করোনা বিজয়ী মনোভাব সবার মধ্যেই।

পাড়ায়–গ্রামে ঘোরার সময় বিশেষ ছিল না। চেনাজানা মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় কিছু তথ্য পেলাম। গ্রামে কৃষিশ্রমিকের ঘোর সংকট। তিন বেলা খাবার, বিড়ি-সিগারেট সহযোগে ৮০০ টাকা মজুরি দিয়েও এবার বোরো মৌসুমে ধান কাটার পর্যাপ্ত শ্রমিক মেলেনি। পাবনা অঞ্চলে যেসব শ্রমিক ধান কেটেছেন, তাঁরা মাঠেই আঁটি করে রেখেছেন। মাঠ থেকে বাড়িতে আনা ও মাড়াই করতে হয়েছে আলাদাভাবে। বগুড়ার পূর্ব অঞ্চলে মজুরির বদলে ধান কাটার জন্যই আধাআধি ভাগ নিয়েছেন শ্রমিকেরা। কৃষক পেয়েছেন অর্ধেক। যাঁরা জমি বর্গা দিয়েছেন, তাঁরা পেয়েছেন চার ভাগের এক ভাগ। বগুড়ার ধুনটবাসী আমার এক বোন বলল, নিজের ও বর্গা মিলিয়ের ওরা বোরো মৌসুমে প্রায় ১০০ মণ ধান পায়। এবার পেয়েছে মাত্র ৩০ মণের মতো। ওদের মতে লোকে এখন গায়েগতরে বেশি খাটতে চায় না। তার বদলে ব্যাটারির রিকশা, অটো বা ভটভটি চালায়। খাটুনি কম। এটা-ওটা বিক্রি করে, নানা কিছু করে। শহরে যায়। কৃষিশ্রমিকের সংকটের এটা একটা কারণ হতে পারে বটে। বিশদ অনুসন্ধান এ যাত্রা সম্ভব হলো না।

ঢাকায় ফিরে স্বজন-সুহৃদদের সঙ্গে ঈদপরবর্তী কুশলাদি বিনিময় করতে গিয়ে জানলাম, লোডশেডিং এখন কিছু কমেছে। রোদ অগ্নিশর্মা। যাঁরা আমন ও আউশ আবাদ করেছিলেন, সব পুড়ে যাচ্ছে। দেরিতে বোনা পাটের দশাও তা-ই। জুলাইতে পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি। দেশের অন্যত্রও প্রায় একই। এ কারণে এখন সবারই প্রার্থনা—বরিষ ধরা–মাঝে শান্তির বারি।

  • আশীষ উর রহমান প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি