ইউক্রেন যুদ্ধ: নিষেধাজ্ঞার এক বছরে রাশিয়া কতটা কাবু

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। এটি রুশ অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে এরপরও দেশটি যে ধরনের অর্থনৈতিক ধসের মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তেমনটা ঘটেনি। এ কারণেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ বছরের শুরুতেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, ‘২০২২ সাল আমাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার বছর ছিল। তবে আমরা সব বাধা সফলতার সঙ্গে উতরাতে সক্ষম হয়েছি।’

প্রকৃতপক্ষেই পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে এতটা খর্ব করতে পারেনি যে ক্রেমলিন ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে। ২০২২ সালের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের নিশ্চিত করেছে, অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়লেও ক্রেমলিন তার রাজনৈতিক প্রভাবকে অটুট রাখতে পেরেছে। 

এত নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার অর্থনীতির টিকে থাকার ক্ষমতার পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৃত্তে দেশটির দৃঢ় অবস্থান। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর শৃঙ্খলের প্রাথমিক পর্যায়ে যে প্রাকৃতিক শিল্পপণ্য অপরিহার্য, তার অন্যতম সরবরাহকারী দেশ হলো রাশিয়া। এটিই তার বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছে। 

যেহেতু জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানো ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, সে কারণে বিশ্ববাজারে রাশিয়ার কাঁচামালের চাহিদা এখনো অটুট রয়েছে। এটিই রাশিয়াকে আরোপিত অবরোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সহায়তা করেছে। 

২০২১ সালে বিশ্ববাজারে মোট সরবরাহকৃত তেলের ১৭.৫ শতাংশ, প্যালাডিয়ামের ৪৭ শতাংশ, নিকেলের ১৬.৭ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়ামের ১৩ শতাংশ এবং পটাশ সারের ২৫ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করেছে। ধারণা করা হয়, একমাত্র বছরের পর বছর ধরে মন্দা ও মূল্যস্ফীতি যদি চলে, তাহলেই বিশ্ব অর্থনীতি রাশিয়ার কাঁচামাল আমদানি করা থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু সে ধরনের মূল্য দেওয়ার বিষয়ে পশ্চিমা রাজনীতিকদের আগ্রহ নেই।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে রাশিয়ার অ্যালুমিনিয়ামের প্রবেশ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল; আর তাতেই সে বছর অ্যালুমিনিয়ামের দর ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। চাপে পড়ে পরে হোয়াইট হাউসকে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়েছিল।

ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ওপর ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা না দিলেও পুতিনের ‘ঠান্ডায় জমিয়ে দাও ও শত্রুদের বিভক্ত করো’ নীতির অংশ হিসেবে রাশিয়া গ্যাসের উৎপাদন ১৮-২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছে। অবস্থার বদল না হলে চলতি বছর আরও ৭-৮ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন কমে যাবে। এতে গোটা ইউরোপে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। 

অনেকটা সে কারণে ২০২২ সালে পশ্চিমারা রাশিয়ার অ্যালুমিনিয়ামের ওপর নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে ইস্পাত, কয়লা, প্রক্রিয়াজাত কাঠের মতো এমন সব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যেগুলোর ওপর পশ্চিমারা শতভাগ নির্ভরশীল নয়। কিন্তু এসব কাঁচামাল রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি কাঁচামাল নয়। ২০২১ সালে রাশিয়া এসব পণ্যের সম্মিলিত রপ্তানির অর্থের পরিমাণ ছিল তার মোট রপ্তানির মাত্র ১১.৭ শতাংশ। ফলে এসব পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করতে না পারায় রাশিয়ার অর্থনীতি বিশেষ কোনো চাপে পড়েনি। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাশিয়ার এসব কাঁচামালের অভাবে বেকায়দায় পড়েছে।

রাশিয়ার তেলশিল্প–সংক্রান্ত ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা যতটা না রাশিয়ার তেল উৎপাদন ঠেকানোকে নিশানা করেছে, তার চেয়ে তারা তেলের বিক্রয়লব্ধ রাজস্ব কমানোর দিকে বেশি নজর দিয়েছে। উৎপাদনে বাধা না পাওয়ায় রাশিয়ার তেল উৎপাদন আগের চেয়ে
বেড়েছে। ২০২২ সালে তাদের তেল উৎপাদন ২ শতাংশ বেড়েছে। রাশিয়া থেকে পরিশোধিত তেল আমদানির নিষেধাজ্ঞা ইইউ কার্যকর করলেও এটি রাশিয়ার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া গ্যাসোলিন ও ডিজেল উৎপাদন ৭ শতাংশ বাড়িয়েছে।

তবে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ওপর ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা না দিলেও পুতিনের ‘ঠান্ডায় জমিয়ে দাও ও শত্রুদের বিভক্ত করো’ নীতির অংশ হিসেবে রাশিয়া গ্যাসের উৎপাদন ১৮-২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছে। অবস্থার বদল না হলে চলতি বছর আরও ৭-৮ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন কমে যাবে। এতে গোটা ইউরোপে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। 

রাশিয়ার ওপর যেসব আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা তাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ জব্দ করা, লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্ব পুঁজিবাজারে নিষেধাজ্ঞা ক্রেমলিনকে চিন্তায় ফেলেছে। তবে তাতে রাশিয়া দিশাহারা হয়নি। 

 আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সের্গেই আলেকসাশেঙ্কো রাশিয়ার সাবেক উপ-অর্থমন্ত্রী