গত ৫ আগস্ট যা ঘটেছে, সেটা হয়তো অনেকেই, হতে পারে কেউই, আশঙ্কা কিংবা আশা করতে পারেননি। তবে যে ধরনের ফ্যাসিবাদী নিষ্পেষণ দেশে কায়েম হয়েছিল এবং ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছিল, তার শেষ যে একভাবে না একভাবে ঘটবে, সেটা সুবিধাভোগী অল্প কিছু মানুষ ছাড়া বাদবাকিরা আশা করছিলেন। অসন্তোষ ও ক্ষোভ—দুটোই বাড়ছিল এবং সরকার ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল, সরকারি মুখপাত্ররা যেভাবে গলা উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, তাঁদের ভেতরটা খালি হয়ে এসেছে। মুখে যতই চিৎকার করে জানাচ্ছিলেন যে তাঁরা ভয় পাওয়ার পাত্র নন, দেশ ছেড়ে পালাবেন এমন কাপুরুষ নন, ততই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে তাঁরা ভয় পেয়েছেন।
ঘটনাটা ঘটাল ছাত্ররা। এই তরুণেরাই অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তারাই ছিল সংগঠক; এমনকি তার আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তাদেরই দেখা গেছে সামনের সারিতে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছাত্ররা সামনে না থাকলে সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধেও তরুণেরাই ছিল প্রধান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনও তারাই শুরু করেছিল। শেখ হাসিনার পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল।
কিন্তু আসলে ঘটেছেটা কী? সেটার বিবেচনা খুবই জরুরি। কেউ বলছেন আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম। কারও কারও ধারণা, একটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। বাস্তবে কিন্তু দুটির কোনোটাই ঘটেনি। যেটা ঘটেছে, তা হলো নৃশংস একটি সরকারের পতন। এ দেশে মানুষ অনেক রকমের সরকার দেখেছে; ব্রিটিশ সরকার আলাদা, সেটা ছিল বিদেশি, পাকিস্তানি শাসকেরাও বিদেশিই ছিল; কিন্তু পতিত সরকারটির মতো স্বদেশি সরকার আগে কেউ কখনো দেখেনি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো সরকারই জনগণের পক্ষে ছিল না, সব সরকারই ছিল জনবিরোধী। শাসকেরা নানাভাবে শোষণ করেছে, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু যে সরকারকে জনগণ এবার বিতাড়িত করল, সেই সরকারের মতো নিষ্ঠুর ও বধির সরকার আর দেখা যায়নি। এই সরকার কোনো আইনকানুন মানেনি, নিষ্পেষণের জন্য নতুন নতুন আইন ও বিধি জারি করেছে, গুম করেছে, হামলা ও মামলা দিয়ে হয়রানির একশেষ ঘটিয়েছে এবং কতটা যে নির্মম হতে পারে, তার প্রমাণ দিয়েছে পতনের আগের কয়েকটি দিনে।
ধারণা করা হচ্ছে, নিহত মানুষের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। আর আহত মানুষের সংখ্যা তো বেশুমার। তালিকা পাওয়া গেছে নিহত ৬৫ শিশু-কিশোরের; তালিকার বাইরে কত শিশু শেষ হয়ে গেছে, কে জানে। নিহত ও আহত ব্যক্তিদেরও অধিকাংশই তরুণ। ইহুদিবাদী ইসরায়েলিরা গাজাকে শৈশবশূন্য করেছে, হাসিনা সরকারও মনে হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে তারুণ্য মুছে ফেলবে। যা আগে কখনো ঘটেনি, তা হলো হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ। এবার সেটাও ঘটল। মানুষ মারার কোনো কায়দাই বাদ রইল না এবং পরিণতি দাঁড়াল চূড়ান্ত রকমের ফ্যাসিবাদী ওই সরকারের পতন।
সরকার পরিবর্তনটা শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটতে পারত, যদি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতো। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত ছিল না। নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন ঘটিয়ে টিকে থাকার আয়োজন করেছে। ফলে পতন শেষ পর্যন্ত ঘটলই, তবে সহিংস উপায়ে। তাতে বহু মানুষ হতাহত হলেন, সম্পদ ও স্থাপনা নষ্ট হলো
সরকার পরিবর্তনটা শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটতে পারত, যদি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতো। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত ছিল না। নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন ঘটিয়ে টিকে থাকার আয়োজন করেছে। ফলে পতন শেষ পর্যন্ত ঘটলই, তবে সহিংস উপায়ে। তাতে বহু মানুষ হতাহত হলেন, সম্পদ ও স্থাপনা নষ্ট হলো। পুলিশ আগেই জনবিচ্ছিন্ন ছিল, এবার তাদের যে ভূমিকায় নামানো হলো, তাতে তাদের ভাবমূর্তি দাঁড়াল জনশত্রুর।
পতনে পরিবর্তন অবশ্যই ঘটেছে। পুরোনোরা বিদায় নিয়েছেন, নতুন মানুষ এসেছেন সামনে। বুর্জোয়াদের রাজনীতি-প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিহিংসার রূপ নেয়; চরম অধঃপতন ঘটলে সে রাজনীতির দশাটা কী দাঁড়ায়, তার নিদর্শন বাংলাদেশে পাওয়া গেল বৈকি। কিন্তু ওই পর্যন্ত তো-ই। একের পতনে অপরের উত্থান। পরিবর্তন ঘটবে না বলে ক্ষমতাসীনেরা দম্ভ করেছিলেন; সে দম্ভ মিথ্যায় পরিণত হয়েছে; তাঁরা পতিত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ‘থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়’ দশা দাঁড়িয়েছে; তাঁরা পলায়নে তৎপর হয়েছেন; না পারলে লুকিয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টায় অস্থির না হয়ে পারেননি; পানি শুকালে মাছের অবস্থা।
কিন্তু পরিবর্তনটা কি শুধুই একটি সরকারের পতন এবং নতুন একটি সরকারের আগমন? মনে হবে তার চেয়ে অনেক অনেক বড় একটা কিছু। তার প্রধান কারণ মানুষের প্রাণপণ প্রতিরোধ এবং সরকারের দিক থেকে ধ্বংসের তাণ্ডব। এর বাইরে আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম অথবা একটি বিপ্লব ঘটে গেছে, এটা ধারণা করা যতটা আশার ব্যাপার, ততটা বাস্তবিক সত্য নয়।
স্বাধীন তো আমরা আগেও হয়েছি, একবার নয়, দু-দুবার। প্রথমে হই সাতচল্লিশে। ‘স্বাধীন’ হওয়ার পরপরই টের পাই যে পড়ে গেছি পরাধীনতার নতুন ফাঁদে। সে জন্য আবার আমাদের যেতে হলো আন্দোলনে, মুখোমুখি হতে হলো ইতিহাসের নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার, নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ করতে হলো সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে। একাত্তরে সে পথেই আমরা আবার স্বাধীন হলাম। সেটাই তো ছিল আমাদের দ্বিতীয় ও প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু যা কাঙ্ক্ষিত ছিল, সেটা হলো মুক্তি।
না, সে মুক্তি পাকিস্তান দেয়নি, বাংলাদেশও দেয়নি। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাস মুক্তির স্বপ্ন থেকে ধারাবাহিকভাবে পিছু হটার ইতিহাস। কিন্তু এমনটা কেন ঘটল? ব্রিটিশ শাসকেরা প্রায় দুই শ বছর ধরে আমাদের শোষণ করেছে, পাচার করেছে আমাদের সম্পদ। যখন তারা আসে, তখন ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ হয়, দুর্ভিক্ষ তারাই বাধায়। ওই দুর্ভিক্ষে তখনকার বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিদায় নেওয়ার সময়ও তারা একটা দুর্ভিক্ষ বাঁধিয়েছিল, যাতে ৩৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
পাকিস্তানি শাসকেরাও একই ধারায় শোষণের জন্য শাসন চালায় এবং আমাদের সম্পদ নিংড়ে নিয়ে যেতে থাকে। রুখে দাঁড়ানোতে তারা গণহত্যা চালায়। প্রাণ যায় ৩০ লাখ মানুষের, সম্ভ্রমহানি ঘটে কমপক্ষে ৩ লাখ নারীর। ওই সব বিদেশি শয়তানকে আমরা তাড়িয়েছি।
কিন্তু মুক্তি পেয়েছি কি?
১৯৭১-এর স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে কতজনের যে প্রাণহানি ঘটেছে, তার হিসাব আমরা জানি না। যে ধরনের নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশ, তা তুলনা বিরহিত। এরপর সেনাশাসন আসে; প্রথমে জিয়ার, পরে এরশাদের। হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে। লক্ষ্যবস্তু ছিলেন মূলত বামপন্থীরা; কারণ, মুক্তির জন্য আন্দোলনটা তাঁরাই করে থাকেন।
শেখ হাসিনার শাসনকালে পুলিশ ও র্যাবের হাতে যেভাবে মানুষ গুম হয়েছে, তার তুলনা তো আমাদের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘মায়ের ডাক’ নামের স্বজন হারানোদের সংগঠন ১৫৮ জনের তালিকা দিয়েছে। কারও কারও ধারণা, সংখ্যাটা আরও বড়; ৭০০ হবে। নির্যাতনের অভিনব সব পন্থা উদ্ভাবন করা হয়েছিল। যাঁরা ফেরত আসতে পেরেছেন, তাঁরাও সাহস পাননি মুখ খুলতে। তুলে নিয়ে যাওয়া একজন বিএনপি নেতা নিজেকে আবিষ্কার করেছেন সীমান্তের অপর পারে, কেমন করে গেলেন তিনি স্মরণ করতে পারেননি।
হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়নের আগের দিন কয়টিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যেভাবে নির্বিচার ও দ্রুততায় মানুষকে হত্যা ও জখম করা হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। জনতার যে ঢল কারফিউ ভেঙে এগিয়ে আসছিল, সেনাবাহিনী যদি তাকে প্রতিহত করতে সম্মত হতো, তাহলে ব্যাপক গণহত্যা ঘটত, রক্তের স্রোত যে কী ধারায় প্রবাহিত হতো, আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়