চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির নাম ‌‌জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির নাম ‌‌জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ

মতামত

বিনা মেঘে জলাবদ্ধতা এবং চট্টগ্রামের প্রকল্প ভাগ্য

জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রামে বৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। কড়া রোদের দিনেও শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো পানিতে ডুবে যায়। চট্টগ্রামবাসীর এই তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা প্রথম আলোসহ স্থানীয় পত্রিকাগুলো ফলাও করে প্রকাশ করেছে ১৫ জুলাই। গত বৃহস্পতিবার নগরীর অনেক এলাকা ছিল পানির নিচে। আষাঢ়ের পূর্ণিমার প্রভাবে কর্ণফুলীতে বেড়েছে পানি। সেই পানি প্রধান খাল দিয়ে ঢুকেছে নগরের রাস্তায়, বাসাবাড়িতে, হাসপাতালে, দোকানপাটসহ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে। চাক্তাই-রাজাখালী সড়ক, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জের চান মিয়া লেন, ইসমাইল ফয়েজ সড়ক, আবু জহুর সড়ক, মিয়া খান সড়ক, পাথরঘাটা, মিয়াখান নগর, বাকলিয়ার বাইদ্দার টেক, ইছহাকের পুল, তক্তার পুল, চকবাজার, হালিশহর, আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বিনা মেঘে জলাবদ্ধতার কবলে ছিল।

শুধু গত বৃহস্পতিবার নয়, প্রতিটি অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় এই অবস্থা। এই দিনের জলাবদ্ধতাটা আগের সব কটিকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার পানির উচ্চতা যেমন বেশি ছিল, তেমনি জলাবদ্ধতাকবলিত ছিল আগের চেয়ে বেশি এলাকা। দিন দিন জলের দাপট বাড়ছে এবং বেশি বেশি এলাকা নিজের করায়ত্ত করছে। আগে বর্ষা এলে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে ‘জলাবদ্ধতাঙ্ক’ দেখা দিত। এখন এটি প্রতিটি ঋতুতে চলছে। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা এবং জোয়ারের অতিরিক্ত পানি যাতে নগরের খালগুলোতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিটি খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে, সেই প্রকল্প শেষ হয় না।

চট্টগ্রাম বন্দরসহ দুই তীরের বিস্তীর্ণ জনপদ, নগর, গ্রাম, কলকারখানাসহ বিচিত্র স্থাপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে কর্ণফুলীর প্রবাহকে সচল রাখতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সময়মতো নদীর ড্রেজিং। অথচ ঠিকাদার নিয়োগ করতে করতেই শেষ হয়ে যায় এই প্রকল্পের মেয়াদ। বারবার ঠিকাদার বাতিল ও নানা জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের কাজ এগোয় না।

চট্টগ্রামের মানুষের দুর্ভোগের এবং নানা উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। এই নগরের প্রধান প্রকল্পগুলো এক বিলম্বিত প্রক্রিয়ার শিকার। দিনের পর দিন এসব প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে, খরচ বাড়ে, কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। এই শহরের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির নাম ‌‌জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। ২০১৭ সালে এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। পরপর দুবার সময় বাড়িয়ে কাজের শেষ হওয়ার সময় নির্ধারণ হয়েছিল এ বছর জুন মাস। প্রকল্পটির মেয়াদ আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।

শুধু জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পটি নয়। চট্টগ্রামে আরও অনেক বড় প্রকল্প চলমান। এগুলো বাস্তবায়িত হলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে, শহরের সৌন্দর্য বাড়বে, যোগাযোগ বাড়বে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়বে। মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটেছে এসব প্রকল্পে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রায় সব প্রকল্প দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়েছে। এক অতিকায় অচলায়তন যেন গ্রাস করেছে চট্টগ্রামকে।

পদ্মা সেতুর মতো মহাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন করে যেখানে বাংলাদেশ নজির সৃষ্টি করেছে, যেখানে নদীর নিচের টানেল বানানোর মতো স্বপ্নপ্রকল্প ঠিক সময়মতো বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেখানে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বিলম্বিত প্রক্রিয়া মানুষকে হতাশ করে।

দীর্ঘ তিন যুগ ধরে চট্টগ্রামের মানুষ নতুন কালুরঘাট সেতুর স্বপ্ন দেখে আসছে। দাবি জানিয়ে আসছে। সেই দাবি পূরণ হচ্ছে না। অথচ ৯২ বছরের জীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে প্রতিদিন অর্ধলক্ষ মানুষ যাতায়াত করে। এই শতাব্দীর প্রথম বছরে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়। প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। একমুখী সেতু বলে এর দুই পাশে, কর্ণফুলীর দুই তীরে পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকে শত শত যানবাহন। এই অবর্ণনীয় কষ্ট এক দিন দুই দিন সহ্য করা যায়, কিন্তু বছরের প্রতিদিন সহ্য করা যায় না।

কালুরঘাট সেতুর নতুন নকশা হয়েছে। এটি একনেকে উত্থাপিত হয়ে অনুমোদন পেতে কত দিন যাবে, আমরা জানি না। কারণ, একনেকে অনুমোদন পেয়ে কাজ শুরু হয়ে বছরের পর বছর চলছে, এ রকম অনেক প্রকল্প ঝুলছে চট্টগ্রামে। দোহাজারী- কক্সবাজার এক শ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের ১৪ বছরের বিলম্বিত প্রক্রিয়ায় দিন দিন শুধু প্রকল্প ব্যয় বাড়েনি, বেড়েছে মানুষের ভোগান্তিও। হবে হবে এই অপেক্ষাতেও দানা বেঁধেছে হতাশা। ২০১০ সালের প্রকল্পের শুরুতে এটি ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্প। এখন এটি ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার প্রকল্প। গত মে মাস পর্যন্ত এর কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৭৫ শতাংশ। মাত্র সাড়ে তিন বছরের এই প্রকল্প ১২ বছর কাল পেরিয়ে গেছে। ২০২৪ সালে শেষ হবে বলে দাবি করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত চট্টগ্রামবাসীর মনে শঙ্কা। আদৌ ১৪ বছরেও কি শেষ হবে? অর্থায়ন, ভূমি অধিগ্রহণ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে জটিলতা ও করোনার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা যতই অজুহাত দিক না কেন, একটা প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১৮ গুণ বেড়ে গেল। এই বাড়তি অর্থ অন্য কোনো প্রকল্পে তো ব্যয় হতে পারত।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথের মতো ভূমি গ্রহণ জটিলতায় আটকে পড়েছে চাক্তাই-কালুরঘাট সড়ক। ১৯৯৫ সালের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে সড়ক ও বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। পরে বেড়ে হলো ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০২২–এর মধ্যভাগে এসে জানা গেল, এই প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৬০ শতাংশ। সাড়ে আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই সড়কে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ১২টি স্লুইসগেট স্থাপন করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে চাক্তাই, রাজাখালী, বলিরহটা, ইস্পাহানি, কালুরঘাট ও নোয়াখালের স্লুইসগেটের নির্মাণকাজ এই বর্ষার আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ হলো না। আর নগরবাসীর ভোগান্তিও কমল না।

নগরের আগ্রাবাদের সিজিএস কলোনিতে গণপূর্ত বিভাগের ৬৮৪ ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল দুই বছরে। এখন চার বছর পেরিয়ে গেছে। ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিটুকু শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। সেই এক বছর কত মাসে হবে, সেটাই দেখার অপেক্ষা।

আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, যখন দেখি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গত এক যুগে একটি নগর ভবন নির্মাণ করতে পারেনি। নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। নগরের আন্দরকিল্লা থেকে দপ্তর গুটিয়ে সিটি করপোরেশনের কার্যালয় এখন টাইগারপাসের পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত একটি ভবনে।

এই ভবন নির্মাণ প্রকল্প এখনো নাকি প্রি-একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ভবনটির স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পুরোনো ভবনের একটি অংশ ভেঙে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। পাইলিংয়ের কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরের মেয়াদে আসেন নতুন মেয়র এম মনজুর আলম। সিটি করপোরেশনের আর্থিক দৈন্যতার কারণে তিনি সেই কাজ এগিয়ে নিতে পারেননি। পরের আ জ ম নাসিরেরও অনেক উদ্যোগ ভেস্তে যায় সরকারের অনীহার কারণে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন পূরণ হবে। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, সিটি করপোরেশনের কাজ নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি প্রয়াত নেতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার এই প্রকল্পের অনুমোদন দেবে, এটা প্রত্যাশা করতে পারে চট্টগ্রামের মানুষ।

চট্টগ্রাম বন্দরসহ দুই তীরের বিস্তীর্ণ জনপদ, নগর, গ্রাম, কলকারখানাসহ বিচিত্র স্থাপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে কর্ণফুলীর প্রবাহকে সচল রাখতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সময়মতো নদীর ড্রেজিং। অথচ ঠিকাদার নিয়োগ করতে করতেই শেষ হয়ে যায় এই প্রকল্পের মেয়াদ। বারবার ঠিকাদার বাতিল ও নানা জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের কাজ এগোয় না।

এ রকম থমকে থাকা প্রকল্পের তালিকা কম নয়। সব কটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। চট্টগ্রামের মানুষের সমস্যা, দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে, চট্টগ্রামকে বাঁচাতে, বাণিজ্যিক রাজধানী মর্যাদা বা গুরুত্ব যথাযথ রাখতে, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে, সারা দেশে উন্নয়নের যে মহোৎসব চলছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে চট্টগ্রামের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো যেন আর বিলম্বিত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সচেষ্ট হবেন, এই প্রত্যাশা।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক