স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ‘শিক্ষা দেওয়া’ হচ্ছে প্রথম আলোকে?

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের ঘটনা এবং শামসুজ্জামানকে রাতের বেলায় উঠিয়ে এনে জেলে ঢোকানোর ঘটনাপ্রবাহ অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ছবি: এএফপি

প্রথম আলো দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করতে সাত বছরের এক বাচ্চার মুখে যা আসার কথা নয়, তার মুখ দিয়ে সেটাই প্রচার করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। তারা এমন কথাও বলল যে পত্রিকাটি এমনকি বাচ্চাটির নামও বদলে দিয়েছে। একটি সাধারণ খবরকে বিকৃত করে কী অসাধারণ বিতর্ক তৈরি করা সম্ভব, তার এক অনন্য নজির আমরা দেখতে পেলাম।

প্রতিবেদনটি পড়লে যে কারওরই বুঝতে পারার কথা যে শিরোনাম ও উদ্ধৃতিতে প্রকাশিত মতামত ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ কথাগুলো শিশুটির নয়, দিনমজুর জাকির হোসেনের। প্রতিবেদনের সঙ্গে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি সবুজ নামের শিশুটির ঠিকই, তবে ছবির পাশে উদ্ধৃতিটির সঙ্গে জাকির হোসেনের নামই ছিল। ছবি ও উদ্ধৃতির এ মিশ্রণ অনেকের কাছে অসংগতিপূর্ণ মনে হতে পারে, কিন্তু তা কীভাবে ফৌজদারি অপরাধ হয়? নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় এবং মানুষের প্রকৃত আয় কমতে থাকায় জীবনযাপন দুঃসহ হয়ে পড়ার কষ্টের কথা কি স্বাধীনতা দিবসে কেউ বলতে পারবে না? ষড়যন্ত্রের অভিযোগকারীরা কতজন মূল প্রতিবেদনটি কিংবা তার পরের সম্পাদিত প্রতিবেদন ও তার ব্যাখ্যা পড়েছেন? চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছনে ছোটার আগে কানটা আসলেই খোয়া গেছে কি না, তা যে দেখে নিতে হয়, বিতর্ক সৃষ্টিকারীরা সেটা বোঝেন না, তা বিশ্বাস করা কঠিন। এ কারণেই সন্দেহ হয়, এ বিতর্কের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রথম আলোকে তার স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার জন্য ‘শিক্ষা দেওয়া’।

দুঃখজনক বিষয় হলো, রাজনীতির নিরিখে প্রায় সমভাবে বিভক্ত আমাদের দেশের অনেক দর্শকই ওই টেলিভিশনের চাতুরীর কৌশলের শিকার হয়েছেন এবং মূল প্রতিবেদনটি না পড়েই আবেগতাড়িত হয়েছেন। যাঁরা অভিযোগ তুলেছেন যে এর পেছনে জাতীয় স্বাধীনতাকে কটাক্ষ ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার ষড়যন্ত্র রয়েছে, তাঁরা কি বলতে চান যে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এতটাই ভঙ্গুর যে দেশের মধ্যে দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার অস্তিত্বের কথা কেউ মনে করিয়ে দিলে তা খর্ব হবে? এই যে ২৯ মার্চ সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তাদের এক সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে বলল, দেশের ৩২ শতাংশ মানুষ খিদে চেপে রেখে না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, তাকে নির্বাচনের বছরে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলা হবে? আমাদের কি নিজেদের ব্যর্থতা পর্যালোচনা করে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য নেই? নাকি সরকারের আত্মবিশ্বাসের এতই অভাব ঘটেছে যে সমালোচনা শুনলেই ক্ষমতা হারানোর ভয় তাদের পেয়ে বসবে?

কোনো সংবাদমাধ্যমই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। পাঠক ও শ্রোতা-দর্শকের কাছে তাদের প্রতিদিন জবাবদিহি করতে হয়। সেদিক থেকে রাজনীতিকেরা ভাগ্যবান যে তাঁদের পাঁচ বছরে একবার ভোটারদের কাছে যেতে হয়। আর নির্বাচন যখন একধরনের নিয়ন্ত্রিত সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়, যেখানে ভোটের আর কোনো মূল্য থাকে না, সেখানে সবকিছু ক্ষমতার নিগড়ে বন্দী। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলা ও সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বিপুল সমর্থন গত কয়েক দিনে দেখা গেল, তাতে প্রমাণ হয় পত্রিকাটির বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতায় পাঠকের আস্থা অবিচল।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের ঘটনা এবং শামসুজ্জামানকে রাতের বেলায় উঠিয়ে এনে জেলে ঢোকানোর ঘটনাপ্রবাহ অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পুলিশের নথি অনুযায়ী, শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বুধবার রাত ২টা ১৫ মিনিটে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন যুবলীগের ঢাকা উত্তর ১১ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। তার দুই ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা স্থানীয় থানার একজন উপপরিদর্শককে নিয়ে সাভারে শামসুজ্জামানের বাড়িতে পৌঁছান। পুলিশের তৎপরতার গতিপ্রকৃতিতে বোঝা যায় যে ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতার মামলাটি আচমকা ও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সেই ঘোষণার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, যাতে তিনি জানিয়েছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে যে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের আর গ্রেপ্তার করা হবে না? তেজগাঁও থানার পুলিশ কেন সেই নির্দেশ পালন করেনি? পরে অবশ্য জানা গেল শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নেওয়া হয়েছে রমনা থানার মামলায়। তাহলে রমনা থানা কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশটি জানত না? শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও জেলে পাঠানোর ঘটনায় প্রমাণিত হলো যে বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি আসলে সরকার যেমনভাবে চাইবে, আইন প্রয়োগকারীরা তেমনভাবেই তা প্রয়োগ করবে।

সরকারের সমালোচনা এবং মুক্তচিন্তাকে দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যে সরকারের অতিপ্রিয় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা-ও আরও একবার প্রমাণিত হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মন্ত্রীরা যতবারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ততবারই প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিশ্রুতির উদ্দেশ্য তা প্রতিপালন নয়, বিরোধিতা সামাল দেওয়া।

আরও বিপজ্জনক ও উদ্বেগের বিষয় হলো, শামসুজ্জামানকে রাতের বেলায় বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া এবং তার পরের ২০ ঘণ্টার কোনো হিসাব না মেলা। সিআইডি এবং পুলিশ স্বীকার না করলেও তাকে যে তারাই তুলে এনেছিল, তার অনেক সাক্ষী আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর সিআইডি তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে তাঁর পরিবার ও স্বজনদের কেন তা জানানো হলো না? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আছে, রাতের বেলায় পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না এবং গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে তা তার পরিবার বা আইনজীবীকে জানাতে হবে। এ নির্দেশনা যদি একজন সাংবাদিকের ক্ষেত্রে না মানা হয়, তাহলে অন্যদের বেলায় এ চর্চা কতটা প্রকট? সিআইডি রাস্তায় ছেড়ে দিল, আর রমনা থানার পুলিশ তাকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করল, এ কেমন প্রহসন? বেআইনি অপহরণ বা গুমের থেকে এর ফারাকটা কোথায়?

সরকারের সমালোচনা এবং মুক্তচিন্তাকে দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যে সরকারের অতিপ্রিয় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা-ও আরও একবার প্রমাণিত হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মন্ত্রীরা যতবারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ততবারই প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিশ্রুতির উদ্দেশ্য তা প্রতিপালন নয়, বিরোধিতা সামাল দেওয়া। আইনকে কথিত ত্রুটিমুক্ত করার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে, তা-ও যে নিছক অজুহাত ছাড়া কিছু নয়, তার সাক্ষ্য মেলে শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতিতে। সরকারকে তাঁদের পরামর্শ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি বলেই এখন তিনি আইনটি স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন।

কথিত ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের প্রচারে তাল মিলিয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিককে রাতের বেলায় বাড়ি থেকে তুলে আনা এবং সম্পাদকসহ সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে যে শিরোনামে প্রচার পেয়েছে এবং যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বণিক সভা এফবিসিসিআই চাঁদা তুলে সিএনএনে ২৭ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক ৩০ মিনিট করে ‘গ্রোয়িং বাংলাদেশ’ নামের যে অনুষ্ঠান প্রচার করাল, সে সম্পর্কে কোথাও কোনো আলোচনা শোনা গেল না। সবটাই হারিয়ে গেল সরকারের সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সমালোচনায়। এর আগেও ২০২১ সালে সরকারের বাণিজ্যবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান সাড়ে চার কোটি ডলার খরচ করেছিল সিএনএনের পেছনে, যাতে দেশের পক্ষে ইতিবাচক প্রচার মেলে। টাকা খরচ করলেই যে শুধু ইমেজ গড়া যায় না, রাষ্ট্রের নীতি ও চর্চাগুলো গণতান্ত্রিক ও মানবিক হতে হয়, সেটাও বোঝা দরকার।

আরেকটি কথা, যারা এখনো প্রেস কাউন্সিলের প্রতি আস্থাশীল, তাদের জন্য একটি ছোট্ট অনুস্মারক—কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটি যে কার্যত সরকারেরই একটি হাতিয়ার তারা কিন্তু তার প্রমাণ রেখেছে কিছুদিন আগে বিরোধী দল বিএনপির পত্রিকা দৈনিক দিনকালের অনুমতি বাতিলের মাধ্যমে। রাষ্ট্র যখন এসব কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তখন আসলে সংবাদমাধ্যম শিল্পের নিজেদেরই একটি বিকল্প ব্যবস্থা দাঁড় করানোর কথা ভাবা দরকার।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক