অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না।
প্রধান উপদেষ্টার এই আশ্বাসের পরও রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা থেকে গিয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, সরকার কেন নির্বাচনের সম্ভাব্য দিন-তারিখ ঘোষণা করছে না?
রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপির নেতারা প্রায় প্রতিদিনই সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। আবার উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকেও একেকজন একেক রকম আভাস-ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন।
আমাদের ধারণা ছিল, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর নতুন বছরের শুরুতে হয়তো দেশবাসী নির্বাচন নিয়ে একটি সুসংবাদ পাবে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণের কথা জানালেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী বছর ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে।’
তবে এখানেও প্রধান উপদেষ্টা ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ রেখেছেন। বলেছেন, ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় খুশি হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহ্উদ্দিন আহমদ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সে জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেতা সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূমও বলেছেন, নির্বাচনের আগে সরকারের উচিত সংস্কারের রোডম্যাপ দেওয়া।
দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘প্রথমে সবচেয়ে বড় কাজ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরও কঠিন হলো এ জন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না।’
প্রধান উপদেষ্টার কথায় মনে হয়েছে, সরকার কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চায় না; তারা জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়ও নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। এখানে আরেকটি সমস্যা হলো, এর আগে গঠিত কমিশনগুলো সরকারের অংশ নয়। সরকার গঠিত কমিশনের সদস্য অর্থাৎ নিযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন হলে সেটা সরকারের অপরিহার্য অংশ হয়ে যাবে।
আসলে কাজটি খুব কঠিন নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, ১৮ বছর বয়সী প্রত্যেক নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, যার ভিত্তিতে নির্ভুল ভোটার তালিকা করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গত তিনটি নির্বাচনে যে মানুষ ভোট দিতে পারেননি, সেটা ভোটার তালিকার গরমিলের কারণে নয়, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ার কারণে। গত তিনটি নির্বাচনে প্রথম ভোটার হওয়া তরুণ-তরুণীরা ভোট না দিলেও তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। ফলে নির্ভুল ভোটার তালিকা করার কাজটি খুব কঠিন বলে যাঁরা প্রধান উপদেষ্টাকে বুঝিয়েছেন, তাঁরা ঠিক পরামর্শ দেননি।
তরুণদের ভোটদান একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতাকে মসৃণ করার সমস্ত আয়োজন করতে হবে। আমার একান্ত ইচ্ছা, এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের তরুণ-তরুণী ভোটাররা শতকরা ১০০ ভাগের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক।’ অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক। যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভোট না দিলে জরিমানা গুনতে হয়। বাংলাদেশে সে রকম কোনো আইন করার কথা অন্তর্বর্তী সরকার ভাবছে কি না, সেটা কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা জানাননি। বেশি ভোটার উপস্থিত থাকলেই যে গণতন্ত্র টেকসই হয় না ২০০৮সালের নির্বাচনই তার প্রমাণ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরা শিগগির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে বলে আমি আশা করি। আমরা এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি “জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন” প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।’
ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজটি কঠিন না হলেও নির্বাচনসহ অন্যান্য সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা খুবই দুরূহ কাজ হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। আনুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বাম দলগুলোর আগ্রহ থাকলেও বিএনপি প্রবলভাবে বিরোধিতা করছে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিষয়েও বাম দলগুলো মোটামুটি সহমত প্রকাশ করছে; কিন্তু বিরোধিতা আসছে ইসলামি দলগুলোর কাছ থেকে। দ্বিকক্ষ বা এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হবে, সে বিষয়েও সব দলের মধ্যে মতৈক্য নেই।
তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত। আর সেটা হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়েও কারও দ্বিমত নেই। তবে সমস্যা হবে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে।
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে যে অধ্যাদেশ নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে, তাতে বলা হয়েছে, সরকারের কেউ পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর বেশ কিছু দিন পার হলেও সেটি অধ্যাদেশ আকারে জারি না হওয়ায় অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়েও সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত।
প্রধান উপদেষ্টার কথায় মনে হয়েছে, সরকার কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চায় না; তারা জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়ও নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। এখানে আরেকটি সমস্যা হলো, এর আগে গঠিত কমিশনগুলো সরকারের অংশ নয়। সরকার গঠিত কমিশনের সদস্য অর্থাৎ নিযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন হলে সেটা সরকারের অপরিহার্য অংশ হয়ে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনী ট্রেন চলার কথা বললেও কোন নির্বাচনী ট্রেন আগে হবে, সেটি খোলসা করেননি। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হওয়ার দাবি জানিয়েছে কোনো কোনো মহল। পাশাপাশি নতুন দল গঠনের তোড়জোড় চলছে।
প্রধান উপদেষ্টা যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে তাঁর প্রস্তাবিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতিকে কতটা একত্র করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি