মতামত

নারীকে নিয়ে চরম আপত্তিকর এসব মন্তব্য পড়লে অসুস্থ বোধ হয়

ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজকাল চোখ রাখাই কঠিন। সস্তা ও চটকদার সংবাদের লিংক, কুরুচিপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম আর বিষয়বস্তুর ছড়াছড়ি দেখলে শিউরে উঠতে হয়।

এসব সংবাদের অধিকাংশই নারীর চেহারা, শরীর আর যৌনতাকে কেন্দ্র করে। নেট দুনিয়ায় এসব চটুল বিষয়বস্তু বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। লাইক, ভিউ আর কমেন্টের জোয়ারে ভেসে নিমেষেই মহামারির রূপ নেয়।

আধেয় বা কনটেন্টের নিচের কমেন্টগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। চরম আপত্তিকর এসব মন্তব্য পড়লে অসুস্থ বোধ হয়। এমনকি নারীর অর্জন কিংবা প্রশংসামূলক কাজেও পিছু ছাড়ে না এই নোংরা মন্তব্যগুলো। বন্ধুমহলের অনেকেই আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে সরে থাকলেই তো আর সমস্যার সমাধান হবে না!

অনেকেই অভিযোগ করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে নারীর প্রতি নির্যাতন ও হয়রানি বাড়ছে। তবে আমার কাছে মনে হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনপ্রিয় হওয়ার আগেও পারিবারিক নির্যাতন, পথেঘাটে নারীকে উত্ত্যক্তকরণসহ নানা ধরনের সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবেই বেশি ছিল।

অনেক পুরুষের যে চোখ, যে মন যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণে জনসমাগমে, অলিতে-গলিতে, নির্জন স্থানে, গণপরিবহনে নারীকে শিকার বানাত, সেই একই চোখ আর মন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামক নিরাপদ প্ল্যাটফর্মে এখন বিচরণ করছে দোর্দণ্ড প্রতাপে; সেই সঙ্গে বাস্তব দুনিয়ার শারীরিক, মানসিক আর যৌন নির্যাতন তো আছেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে নারীর প্রতি পুরুষের ঘৃণা ও সহিংস আচরণ এখন প্রকটভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে, আর পার্থক্যটা এখানেই। মাধ্যম যা–ই হোক না কেন, নারীর প্রতি নির্যাতন থামছেই না, বরং বেড়েই চলেছে। নির্যাতন শুধু সংখ্যাতেই বাড়েনি; নির্যাতনের ধরন পাল্টেছে, নির্যাতনের মাত্রা আরও ভয়াবহ হয়েছে।

গত ২৫ এপ্রিল প্রথম আলো ‘নারী নির্যাতন চলছেই’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বেরিয়ে এসেছে নারীর প্রতি নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। এখানে উল্লেখ করা হয়, পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইনে ২০২৩ সালে প্রায় ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা হয়েছে। আমরা জানি, নারী নির্যাতনের ঘটনার খুব সামান্য অংশই সামনে আসে। নারী নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা তাই অনেক বেশি।

আজকের নারী সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী পুরুষ চান না। নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হওয়ায় নারীকে প্রতিমুহূর্তে নিজের আয়ত্তে রাখার সনাতনী ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে পুরুষকে। পেশিশক্তি প্রদর্শন না করে কিংবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নোংরা মন্তব্য না করেও যে পুরুষ হওয়া যায়, সেটি বোঝার সময় হয়েছে এখন। সময় হয়েছে ‘পুরুষ’ শব্দটির ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। আজকের পুরুষের নতুন রূপটি হোক মানবিক ও সংবেদনশীল পুরুষ।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট ৫৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন; যাঁদের ৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, ২০৭ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নারী নির্যাতনের কথা জানিয়ে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ তাৎক্ষণিক অভিযোগ এসেছে ২৬ হাজার ৭৯৭টি। অনলাইনে প্ল্যাটফর্মেও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন নারী।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। বাস্তব জগৎ কিংবা ভার্চ্যুয়াল, মাধ্যম যা–ই হোক না কেন, একজন নারী যখন একান্ত নিরুপায় হয়ে পড়েন, তখনই তিনি সাধারণত অভিযোগ জানান কিংবা আইনের আশ্রয় নেন।

প্রশ্ন হলো, নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা কেন বাড়ছে? কেন এত ক্রোধ আর প্রতিহিংসা নারীর প্রতি? অথচ পৃথিবীর ইতিহাস বলে, পুরুষের তুলনায় নারী অনেক বেশি শান্তিপ্রিয় ও কম অপরাধপ্রবণ। অপরাধ কম করেও অপরাধের শিকার হচ্ছেন নারী। যে মাতৃগর্ভে প্রতিটি পুরুষের উৎপত্তি, সেই পুরুষ কী করে নারীর প্রতি এতটা সহিংস আচরণ করতে পারেন, তা ভাবতেই অবাক লাগে। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলো প্রধান বলে আমার মনে হয়, তা হলো:

১. আজকের শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর পরিবর্তিত নতুন রূপটি মেনে নিতে পুরুষ এখনো তৈরি নন। ফলে তাঁরা নারীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন, হীনম্মন্যতায় ভুগছেন এবং নারীর অবস্থান নড়বড়ে করতে তাঁরা সব ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে দ্বন্দ্ব আর সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।

২. সমাজে এত দিন ধরে ভোগ করতে থাকা পুরুষের সুবিধাজনক অবস্থানটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে তাঁরা সহিংস হয়ে উঠছেন। এত দিন প্রভুর আসনে আসীন পুরুষ নারীর সম–অবস্থানে থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ফলে তাঁরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন।

৩. পুরুষের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া ও সমাজে পুরুষের প্রচলিত রূপটি তাঁকে নারীর প্রতি সহিংস, কর্তৃত্ববাদী ও আধিপত্যবাদী করে তুলছে। পুরুষ হয়ে ওঠার সামাজিক চাপ শুধু নারী নন, পুরুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

৪. আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মিডিয়া নারীকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছে যুগের পর যুগ, সেটিও নারীকে অবদমন করেছে এবং নারীর প্রতি সহিংস ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছে পুরুষকে।

৫. নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় আর অবিচারের বিপরীতে শাস্তির উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আসা মামলা বিশ্লেষণ করে ২০১৮ সালে প্রথম আলো দেখিয়েছিল, সাজা হয় মাত্র ৩ শতাংশ মামলায়, যা প্রায় না হওয়ারই শামিল। সর্বোপরি একে তো আইনের প্রয়োগে দুর্বলতা আছে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনগুলোও নারীকে পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে পারেনি। তাই আইনগুলোর সংস্কারও জরুরি।

পরিস্থিতির উত্তরণে প্রথমেই যে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো নারী ও পুরুষের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকার দৃশ্যমান পার্থক্য দূর করা। সমাজের প্রতিটি স্তরে এবং পেশায় নারী-পুরুষের ভারসাম্য ও সমতাপূর্ণ অবস্থান ও ভূমিকা নারীকে পুরুষের চোখে শক্তিশালী করবে।

ফলে নারীর প্রতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসবেন তাঁরা। আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা বলে, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের পরিবর্তন সবচেয়ে জরুরি। আর সেটি তখনই সম্ভব হবে, যখন একজন পুরুষ ‘কর্তৃত্ববাদী ও সহিংস পুরুষ’ হওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে পারবেন।

আজকের নারী সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী পুরুষ চান না। নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হওয়ায় নারীকে প্রতিমুহূর্তে নিজের আয়ত্তে রাখার সনাতনী ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে পুরুষকে। পেশিশক্তি প্রদর্শন না করে কিংবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নোংরা মন্তব্য না করেও যে পুরুষ হওয়া যায়, সেটি বোঝার সময় হয়েছে এখন। সময় হয়েছে ‘পুরুষ’ শব্দটির ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। আজকের পুরুষের নতুন রূপটি হোক মানবিক ও সংবেদনশীল পুরুষ।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    purba_du@yahoo.com