আসুন, আমরা প্রত্যেকে অন্তত কিছুদিন বহুতল ভবনগুলোর বারোয়ারি মনোহর দোকানপাতিতে যাওয়া বন্ধ করি। আমরা, মানে যাদের এমন মরণফাঁদ ভবনে সুখাদ্য খেতে বা সদাইপাতি করতে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে।
আসুন, আমরা দল বেঁধে এ কাজটি করি। প্রতিবাদ করার জন্য, চাপ দেওয়ার জন্য, প্রতিকার আনার জন্য। কেননা, একা আমি বা আপনি কিছুই করতে পারব না।
রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব নেওয়া সরকার এক অতিকায় ক্ষমতাধর কর্তৃপক্ষ। সব দেশে, সব কালে। সরকার একমাত্র কর্তৃপক্ষ নয়। দশের জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যিনি বা যাঁরা রাখেন, তাঁরা সবাই ‘কর্তৃপক্ষ’। তাঁদের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণের ভার আমরা সরকারকে দিয়েছি।
এমন কর্তৃপক্ষ আছেন, যাঁরা স্বাধীন। জনমানুষের বেঁচে থাকা, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের স্বাধীন থাকা জরুরি। তাঁরা নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, এমনটা আমরা প্রত্যাশা করি। যেমন বিচারের কর্তৃপক্ষ। যেমন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা। কিন্তু সকল ক্ষমতাই দানবিক হওয়ার ক্ষমতা রাখে। মানুষকে বাঁচানোর বদলে মারার আয়োজনে শামিল হতে পারে। সকল ক্ষমতাই নোটভর্তি খাম আর স্বার্থের টোপ গিলতে বেশি তৎপর হতে পারে।
রাষ্ট্রেরও প্রধান আছেন। তিনিও ক্ষমতা ধারণ করেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো আমরা, আম-জাম-শাপলা-কাঁঠাল-দোয়েল জনমানুষ—এই প্রজাতন্ত্রের সর্বসাধারণ। আসুন, আমরা দল বেঁধে যে যার জায়গা থেকে সরকার এবং ক্ষমতাধরদের গায়ে অন্তত টোকাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করি। এবং সেখানেই থেমে না থাকি।
যে যেখান থেকে পারি, চাপ দেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখি। চিৎকার করে আওয়াজ তুলি। আমাদের জীবনের দায়িত্ব নিতে আমরা সরকার এবং ক্ষমতাধরদের বাধ্য করি। তাদের কড়া নজরে রাখি এবং তারা ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত চোখের পাতা বন্ধ না করি। ভুলে না যাই।
কাজটা কোথাও থেকে শুরু তো করতে হবে। আগুনে পোড়া কালো ২৯ ফেব্রুয়ারির পটভূমিতে তাই আমরা তাবৎ মালিক-ব্যবসায়ীকে বলতেই থাকি, আমাদের প্রাণের নিশ্চয়তা না দিয়ে আপনারা কিছুতেই নিজেদের লাভের টাকা গুনতে পারবেন না। এই সকল সম্ভাব্য দোজখে যাঁরা ছোট-বড় বা দীনহীন কাজ করে জীবিকার জোগাড় করেন, তাঁদেরও আমাদের দলে নিই।
তাঁদের বলি, আমাদের বর্জনে মালিকদের ব্যবসায় টান পড়লে আপনারা প্রাপ্য টাকার জন্য বিক্ষোভ করুন। কচ্ছপের কামড় দিন। তাঁরা যদি কাজ হারান, আমরা সবাই তাঁদের পাশে থাকি। ঠিক যেমন আগুন অথবা অন্য কোনো বিপর্যয়ের পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের তাৎক্ষণিক সহায়তা জোগাতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি, পাশে থাকার জন্য আকুল তাগিদ বোধ করি, তেমন আন্তরিক টানে।
আমরা পাড়ায় পাড়ায় দল গড়ি—সর্বসাধারণের দল। যে যখন যে জায়গায় যে কাজে যাব, মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা আছে দেখি, বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করি। সবাইকে জানাই।
প্রতিকার দাবি করি। দোকানপাতি তো শুধু বড় ভবনে নেই। আমাদের জীবনের ঝুঁকি ছড়িয়ে আছে বাজারে, কর্মক্ষেত্রে, নিজের বসতিতে। সে ঝুঁকি কেবল যে আগুনেই সীমিত, তা-ও নয়।
প্রাণের নিশ্চয়তা প্রথম কথা। কিন্তু কেবল বেঁচে থাকাটাই বাঁচা নয়। প্রত্যেকে এবং সবাই মিলে সবটুকু অধিকার আর সুযোগ না পেলে ভালোভাবে বাঁচা যায় না। আসুন, আমরা তাই দল বাঁধি সকল ক্ষমতার মধ্যে থাকা দুর্বৃত্ত শক্তিতে দমন করার জন্য। কাঁদাকাটা, দুঃখপ্রকাশ, নিহত ও বিপর্যস্ত মানুষের করুণ কথা—শুধু এসবে কাজ হবে না।
আমাদের সোচ্চার হতে হবে, যুঝতে হবে, কাজ করতে হবে। আন্তরিকভাবে, সততার সঙ্গে, এবং এ কথা মনে রেখে যে এই দুর্বৃত্ত চক্র টিকে থাকলে যেকোনো দিন আমিও তার বলি হবই। বস্তি, পোশাক কারখানা, বিপণিবিতান, বাজার, সড়ক—সব জায়গার সব ধরনের আগুন আসলে আমাকেই খুঁজছে।
অনেক বছর আগে কেনিয়ার নোবেল বিজয়ী গাছবন্ধু ও মানবাধিকারকর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মুখ থেকে একটা গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। গল্পটা আমি সব সময় সবাইকে বলি।
দাবানলে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বাঘ-সিংহ সব অসহায় দর্শক। কিন্তু একলা এক ছোট্ট টুনটুনি দূরের ঝরনা থেকে ঠোঁটে এক ফোঁটা করে পানি এনে আগুনে ঢেলে চলেছে। সবাই তাকে এই অযথা কাজে ক্ষান্ত দিতে বলছে। টুনটুনি তার কাজ থামাচ্ছে না। তার কথা, সে যতটুকু পারে, ততটুকুই করছে এবং করবে।
আমি খুব খারাপ জাতের মানুষ হয়ে গেছি। সব জায়গায় ঝগড়া করি, তর্ক করি, দাবি করি, বাগড়া দিই। আমি মনে করি, এই খারাপ হওয়ার দরকার আছে। কিন্তু শুধু এমন খারাপ হলে তো চলবে না। একা আমি এমন খারাপ হলেও আগুন নিভবে না।
কবি শঙ্খ ঘোষের ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’ বইতে একটি কবিতার শিরোনাম ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’। পুরোটা তুলে দিই এবং আপনাদের পড়তে অনুরোধ করি:
‘আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে!
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমনই ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’
বেঁধে বেঁধে থেকে না যুঝলে আমরা কেউই বাঁচব না।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক
qurratul.tahmina@gmail.com