সাভারে মহাসড়কে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ৩ সেপ্টেম্বর
সাভারে মহাসড়কে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ৩ সেপ্টেম্বর

সরকারকে যেসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে

দীর্ঘ স্বৈরশাসন আমলে খুন–গুমের হিসাব এখনো যথাযথভাবে হয়নি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে পুলিশ, র‍্যাব কিংবা সরকারি দলের বিভিন্ন সন্ত্রাসী দখলদার বাহিনীর হাতে যত মানুষ খুন হয়েছে, জখম হয়েছে, তার বিচারকাজ অনেক বাকি। ত্বকী, তনু, সাগর-রুনি, মুনিয়ার হত্যাকাণ্ড খুবই আলোচিত, সেগুলোর বিচার দ্রুত সম্পন্ন হবে, সেটাই সবাই আশা করছেন, বাকিগুলোও দ্রুত শুরু করতে হবে।

আমি এখানে বিশেষভাবে পুলিশ ও সরকারি গুন্ডা বাহিনীর হাতে খুন জখম হওয়া শ্রমিকদের বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন ধরে কথা বলছি। গত বছরের অক্টোবর–নভেম্বরে মজুরি আন্দোলনের সময়ে শ্রমিকদের ওপর পাইকারি হামলা গুলিবর্ষণ করেছিল পুলিশ ও সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনী। এগুলো এতই নির্বিচার ছিল যে নিহত ও আহত হয়েছেন পথচারীরাও।

আমরা জানি, দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। অর্থনীতির এবং মালিকদের মুনাফার প্রবৃদ্ধি ঘটলেও বিভিন্ন খাতে যে মজুরি চালু আছে, তার যুক্তিসংগত প্রবৃদ্ধি ঘটেনি। সে কারণেই উৎপাদন ও রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও আমাদের শ্রমিকদের মজুরি বিশ্বে সর্বনিম্ন। এরপরও মজুরি বকেয়া থাকে, যৌক্তিক মজুরির জন্য শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়। বিনিময়ে পাওয়া যায় হামলা, মামলা ও গুলি! 

দারিদ্র্যসীমার আয়, মূল্যস্ফীতি এবং প্রকট আয়বৈষম্যের মধ্যে এবারের ঘোষিত মজুরিও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। পুলিশ, বিজিবি ও সন্ত্রাসী বাহিনীর চাপের মুখে সেই কম মজুরি শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর কমিউনিটি পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, থানার পুলিশ, বিজিবি, এমনকি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা এবং এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগদের বাহিনী দিয়ে একযোগে শ্রমিকদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হয়েছে।

এর কারণে গত বছর ৩০ অক্টোবর গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে রাসেল হাওলাদার ও আগুনে পুড়ে ইমরান হোসেন, ৮ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে আঞ্জুয়ারা বেগম ও জালাল উদ্দিন নিহত হন। সরকারের পক্ষ থেকে এর তদন্ত ও বিচারের বদলে উল্টো হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি ও পুলিশের জন্য আটক–বাণিজ্যের ব্যবস্থা করা হয়। আগেও ঘটেছে এ রকম। কিন্তু সেগুলোরও কোনো তদন্ত ও বিচার হয়নি। 

বারবার এ রকম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হই। যেমন শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য ন্যূনতম মজুরি চাওয়ার পরিণামে শিল্পাঞ্চল রক্তাক্ত হয় কেন? কেন অকালমৃত্যু হয় নারী-পুরুষের? কেন জখম হন শত শত শ্রমিক? কেন প্রতিবছর ন্যূনতম মজুরি চাইতে আন্দোলনে নামতে হয়? কেন রাষ্ট্র তার সব রকম সংস্থা নিয়ে সব সময়ই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়? পুলিশসহ নানা বাহিনী কি প্রচলিত আইনও মান্য করে? কীভাবে মালিকেরা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শ্রমিকদের ওপর হামলা হুমকি চালান? 

এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা গত ২২ মার্চ ‘মজুরি আন্দোলনে শ্রমিক হতাহতে গণতদন্ত কমিটি’ গঠন করি। আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠক, অর্থনীতিবিদ, লেখক, গবেষক সমন্বয়ে গঠিত হয় এই কমিটি। আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে প্রকাশিত খবর, লেখালেখি, রিপোর্ট পর্যালোচনার পাশাপাশি শ্রমিক, মালিক, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। নিহত ও আহত শ্রমিক পরিবারসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করা হয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার মধ্যেই এই তদন্তকাজ করতে হয়েছে। 

গণতদন্ত কমিটির অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন ব্যক্তির ভাষ্য, দলিলপত্র, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, সাক্ষাৎকার—সবকিছু পর্যালোচনা করে আমরা একমত সিদ্ধান্তে এসেছি যে:

১. মজুরি এবং কারখানায় নানাবিধ অন্যায় অবিচারে শ্রমিকদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

২. কিন্তু এ বিষয়ে যথাযথভাবে নিজেদের মত ও অভিযোগ জানানোর জন্য সংগঠন বা স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন নেই। এগুলো করার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা তৈরি করে রাখা আছে।

৩. মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষা ছাড়া শিল্প পুলিশের আর কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। মালিক নিয়োজিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও শ্রমিকদের ওপর আক্রমণাত্মক ভূমিকাই পালন করে। প্রশাসনকে একই ভূমিকায় দেখা যায়।

৪. আলোচ্য শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় প্রধান দায় রাষ্ট্রের প্রশাসন, পুলিশ ও মালিকপক্ষের। তারা বিদ্যমান আইনও লঙ্ঘন করেছে। 

সামগ্রিক তদন্তের মাধ্যমে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আবশ্যক, সেগুলো চিহ্নিত করে আমরা সরকারের উদ্দেশে সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছি। গত কয়েক মাসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাষ্ট্রীয় নৃশংসতা, পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকা আমাদের সামনে এর পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের যে তাগিদ উপস্থিত করেছে, তাতে এই সুপারিশমালা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। সুপারিশমালায় আছে: 

১. শ্রমিক হত্যার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

২. পুলিশ ও তৎকালীন সরকারি দলের সন্ত্রাসী বাহিনী শ্রমিকদের ওপর হামলা করেছে, গুলি করে হতাহত করেছে তারপর আবার সেই শ্রমিকদের নামেই মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করেছে, নির্যাতন করেছে। হয়রানি এখনো অব্যাহত রেখেছে। অবিলম্বে সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। 

৩. প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে কোনো পুলিশ যদি কাউকে খুন কিংবা জখম করে, তাহলে ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও তার দায়িত্ব নিতে হবে। 

৪. আমরা বরাবর দেখছি শিল্প পুলিশ তার ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী মালিকপক্ষের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যা শিল্প পরিবেশ ক্ষুণ্ন করে এবং শিল্পাঙ্গনে অনাস্থা ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সে জন্য শিল্পের স্বার্থেই এই বাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে। 

৫. সাধারণভাবে পুলিশ যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী হওয়ার বদলে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে কাজ করে কিংবা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে শ্রমজীবী মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়, তার কারণ এর গঠন ও নিয়োগপ্রক্রিয়া। আমলানির্ভর বিদ্যমান নিয়োগপ্রক্রিয়া পরিবর্তন করে পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনে নাগরিকদের সংশ্লিষ্ট করে নতুনভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু করতে হবে। 

৬. মজুরি নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদে তার পুনর্বিন্যাস করার গ্রহণযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মজুরি নিয়ে আন্দোলনে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে না হয়। মজুরি বকেয়া রাখা, জালিয়াতি, প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। 

৭. কারখানায় সুস্থ কর্মপরিবেশ এবং সব শ্রমিকের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার বাধাগ্রস্ত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। 

৮. বাংলাদেশে কার্যকর শ্রম আদালত নেই। যতটুকু আছে, তাতে শ্রমিকদের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব। শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং শ্রমিকদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিতে হবে।

৯. শ্রমিক হতাহতের ক্ষতিপূরণ বর্তমানে যেভাবে নির্ধারণ করা হয়, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, অপমানজনক। ক্ষতিপূরণ এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে হতাহতের জীবনের জন্য যথেষ্ট হয় এবং একই সঙ্গে তা যাতে অপরাধীর জন্য যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারে। 

শিক্ষার্থী-গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। জুলাই–আগস্ট আন্দোলনকালে পুলিশ কিংবা অন্য বাহিনীগুলোর আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এতে শতাধিক শ্রমিকসহ হাজারখানেক মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন বহু হাজার। এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শ্রমজীবী পরিবারের। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে তাদের স্বার্থ তাদের অধিকার অন্যতম প্রধান বিবেচনা হতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে বৈষম্য দমন–পীড়ন নৃশংসতার অবসান হবে না। এই সুপারিশমালার বাস্তবায়ন এই পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক