ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কেমন মৃত্যু রুবিনা আক্তারের?

গাড়ির চাকার নিচে হতভাগ্য রুবিনা আক্তার। চালকের আসনে নির্বিকার ঘাতক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ
ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যায় পত্রিকার পাতার কাজ শেষ। সেসময় আসলেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম। সহকর্মী কবি ও কলামলেখক সোহরাব হাসান তো ছিলেনই। ফলে আড্ডা জমে গেল। পত্রিকা অফিসে যা হয় আর কি। আড্ডা বলতে এখান-সেখান ঘুরেফিরে শেষে দেশ দুনিয়ার গোষ্ঠী উদ্ধার করা। সম্প্রতি ব্যাংক খাতে লুটপাট, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চক্করে ফেলে নাগরিক অধিকারহরণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ঢাকার বাতাসে অতিরিক্ত ধুলাবালি, রাজনীতির হালচাল, ওএমএসের চালের জন্য মানুষের লাইন কত কিছু! প্রাধান্য হয়ে ওঠে মানুষের কষ্টের কথা। আড্ডা শেষ হয় একটি বাক্যের মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে জন্মগ্রহণ করাই যেন কোনো মানুষের জন্য অভিশাপ। এটি আসলে আফসোসের বহিঃপ্রকাশ। যা হরহামেশাই আমরা করে থাকি।

কিছুক্ষণ পরে এ কথাটারই করুণ সত্যতা টের পেলাম। প্রথম আলো অনলাইনে প্রধান শিরোনাম: ‘ঢাবি এলাকায় গাড়ির নিচে আটকে পড়া নারীকে নিয়েই ছুটল গাড়িটি।’ সাথে সাথেই ক্লিক করলাম। পড়ার আগেই কামনা করছিলাম, নারীটি যেন বেঁচে থাকেন। পড়তে পড়তে তা-ই মনে হচ্ছিল। একপর্যায়ে যখন দেখলাম ‘ওই নারীকে জীবিত উদ্ধার করেন পথচারীরা’, তখন কী এক আশার সঞ্চার হলো। কিন্তু সর্বশেষে গিয়ে বুকটা ভেঙে গেল। পুলিশ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বক্তব্য: ‘আহত নারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।’

বাচ্চু মিয়া দিনে-রাতে-বিরাতে এভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের মৃত্যুর খবর দিয়ে যান। সংবাদমাধ্যমে অল্প কয়েক বছরের কাজে এভাবেই দেখে আসছি বাচ্চু মিয়াকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক। মাঝেমধ্যে তাঁকে মনে হয় মৃত্যুর ফেরিওয়ালা। তাঁর কাছে মৃত্যুর খবর ছাড়া যেন কোনো খবরই থাকে না। ইচ্ছা করে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে জিজ্ঞাসা করি: ‘বাচ্চু ভাই, আপনার বুকটা ভার লাগে না কখনো?’ আমি জানি বাচ্চু এমনই উত্তর দেবেন: ‘আসলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’

ঠিক, এই অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা আসলে বেঁচে আছি। আমরা প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনায় অভ্যস্ত, শিশু হত্যায় অভ্যস্ত, সড়ক দুর্ঘটনায় অভ্যস্ত। আমাদের এই অভ্যস্ততার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘই হচ্ছে শুধু। এখানে আমরা বলতে শুধু জনগণ না। যে জনগণই ভুক্তভোগী, তার ওপরেই যত দায় চাপিয়ে দেওয়া হবে যাবে তাহলে। তাকে এই অভ্যস্ততার আফিম খাইয়ে দিয়েছে আর কেউ না—রাষ্ট্র ও সরকার। নয়তো দিনের পর দিন সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রেখে এবং প্রয়োজনে সেটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো যে কোনোভাবেই সম্ভব না!

২.

ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আপনি বা আমি আবার নিরাপদে ফিরতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমনটি রুবিনা আক্তার ফিরতে পারেননি তাঁর সন্তানের কাছে। সড়কে কোনো মৃত্যুই মেনে নেওয়ার নয়, সেখানে যেভাবে তাঁর মৃত্যু হলো তা আরও নয়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন লিখেছে: ‘ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। চারুকলা অনুষদের উল্টো পাশের টিএসসি অভিমুখী সড়কে এক নারী তাঁর গাড়ির নিচে পড়ে আটকে যান। তবে চালক গাড়ি না থামিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালাতে থাকেন। পথচারীরা তাঁকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। গাড়ির নিচে আটকে থাকা নারীকে নিয়েই টিএসসি থেকে বেপরোয়া গতিতে নীলক্ষেতের দিকে যান চালক। পেছনে পথচারীরা তাঁকে তাড়া করেন। পরে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ থেকে পলাশী অভিমুখী সড়কের মুখে চালককে আটকে ওই নারীকে জীবিত উদ্ধার করেন পথচারীরা চালককে দেওয়া হয় গণপিটুনি।’

প্রতিবেদনের শেষের অংশ তো শুরুতেই উল্লেখ করেছি। প্রথম আলো পরে আরেকটি প্রতিবেদনে জানালো, সেই গাড়িচালক হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিরই সাবেক একজন শিক্ষক। তাঁর নাম মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ক্লাসসহ একাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানলাম, প্রায় এক কিলোমিটার পথ চাকার নিচে আটকে থাকা রুবিনাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেছেন আজহার। গণতন্ত্র তোরণ পার হয়ে গাড়ির জটলায় আটকে না পড়লে এবং পথচারীরা তাঁকে পাকড়াও না করলে হয়তো আরও কিছুদূর নিয়েও ক্ষান্ত হতেন না তিনি। পথচারীরা পেছন থেকে দৌড়ে চিৎকার করে তাঁকে থামানোর চেষ্টা করছিলেন। তবুও তিনি গাড়ি চালিয়ে গেছেন। ওদিকে রাস্তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল রুবিনার রক্ত–মাংস, তবুও তিনি থামলেন না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রুবিনার মৃত্যুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। ফেসবুকে মোহাম্মদ মাসুদ হাওলাদার নামে একজন লিখেছেন, ‘বীভৎস! ভিডিওটা দেখে ঠিক থাকতে পারছি না। সাধারণ মানুষের জীবনের কানাকড়ি মূল্যও কি অবশিষ্ট নেই এই মৃত্যু-উপত্যকায়?’। এরপর কয়েকবারই ভিডিওটি চোখে পড়ল। পুরোটা দেখার সাহস হয়নি। শেষ মুহুর্তে দেখলাম, গণতন্ত্র তোরণ পার হয়ে যাচ্ছে গাড়িটি। হেমন্তের বিকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে ওঠছে গাড়িটি। রোদ এসে লাগছে রুবিনা আক্তারের গায়েও। আহা, রুবিনার প্রাণটা তখন কেমন ছটফট করছিল! ভিডিও ও ছবিতে মোহাম্মদ আজহারকে দেখলাম, একেবারেই নির্বিকার। একজন শিক্ষক, অথচ কোনো মানবিকতাই যার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। চাকার নিচে আটকে পড়া একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে টেনে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে কীভাবে পারলেন। বারবার শুধু একটি প্রশ্নই মাথার মধ্যে ঘুরছে, কীভাবে পারলেন তিনি!

ক্ষুব্ধ পথচারীরা তাঁকে গণপিটুনি দিয়েছে। গণপিটুনিতে তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। এই গণপিটুনি মানুষের প্রতিশোধের স্পৃহার প্রতিফলন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দেশে এটিই তো হওয়ার কথা, আগেও একাধিকবার তেমনটি আমরা দেখেছি।

৩.

রুবিনা আক্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নন। ফলে এমন নৃশংস ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেননি। এ রাষ্ট্রের জন্য এটিও কি বড় অসহায়ত্ব নয়? এরপরেও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন অল্পকয়েক কর্মী নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছেন তারা।

অবস্থানের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে সাধারণ মানুষ ও গাড়ি চলাচল থাকবেই। সেটি বন্ধ করার সুযোগ নেই আসলে। তবে সড়ক নিরাপত্তার জন্য অনেক কিছুই করার আছে সিটি করপোরেশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের প্রায়সময় একটি দাবি থাকে, ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করা হোক। কারণ, সারাদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় লেগে থাকে সেখানে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নানাভাবে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। কথা হচ্ছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে বছরের পর বছর ধরে বহিরাগতদের অবস্থান থাকে সেখানে কীভাবে ক্যাম্পাসে সাধারণ মানুষের অবাধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

আরও বড় ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে ক্যাম্পাসে আসার উৎসাহিত করতে নানা ব্যবস্থা চালু করে রেখেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই। কোনো এক সন্ধ্যায় বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ কয়েকটি জায়গায় পা রাখলে যে কারও মনে হতে পারে, ভুল করে গুলিস্তান চলে এসেছেন কী না। অসংখ্য হকার, খাবারের দোকান, ফেরিওয়ালার পসরা। অস্থায়ী এসব দোকান ও ফেরিওয়ালার থেকে দৈনিক চাঁদার ভাগ কাদের কাদের পকেটে যায়, সেটি একটু কান পাতলেই শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেসব দেখেও না দেখার ভান করে। তার মানে কি চাঁদার ভাগ তাদের পকেটেও যায়?

বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি জায়গায় বিশাল বিশাল পর্দা লাগানো হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেখানে খেলা দেখতে যাচ্ছে। তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত আসলে? দেখেই মনে হবে, বড় অংশ তো বাইরে থেকে আসা। খেলা চলাকালীন বাইরে গাড়ির যানজট লেগেই থাকে। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এমন দৃশ্য ক্যাম্পাসে আগে কোনোবারই দেখা যায়নি। দেশের চলমান নানা সংকটের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দায় পড়েছে, গোটা শহরের মানুষকে ডেকে নিয়ে এসে খেলা দেখানোর? এভাবে সাধারণ মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হতে সেখানকার প্রশাসনই নানাভাবে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। ফলে ক্যাম্পাস প্রশাসন কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।

রুবিনা আক্তারের স্বামী মারা গেছেন দুই বছর আগে। এবার তিনিও চলে গেলেন। তাঁদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি এতিম হয়ে গেল। তার কাছে কী জবাব দেব আমরা—এই রাষ্ট্র, এই সরকার, এই প্রশাসন, এই বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবে সড়কে নির্মমতায় কত শিশু এতিম হয়ে যায়, সেই পরিসংখ্যানও কি আমরা কখনো রেখেছি?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক। ইমেইল: galib.mujahid@prothomalo.com