মতামত

যুক্তরাষ্ট্রের মহা ভুলেই এমন সুযোগ পেয়েছে চীন ও রাশিয়া

‘মিশন সম্পন্ন’ লেখা একটা ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে বুশ ঘোষণা করেন, ‘স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে, ইরাক এখন মুক্ত।’
ছবি : এএফপি

২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন শুরু করেছিল। এই আগ্রাসন কেন প্রয়োজনীয়, সেটার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, ইরাকের জনগণকে মুক্ত করতে এবং বিশ্বকে গভীর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই আগ্রাসন চালানো হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ পর বুশ জোর গলায় দাবি করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা সফল হয়েছেন। তাঁরা ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছেন এবং তাঁর সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছেন। টম ক্রুজের স্টাইলে বুশ একটি মার্কিন রণতরিতে নামেন—এই ছবিকে মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে জাঁকালো ছবি হিসেবে ধরা হয়। ‘মিশন সম্পন্ন’ লেখা একটা ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে বুশ ঘোষণা করেন, ‘স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে, ইরাক এখন মুক্ত।’

বুশের এই ‘সফলতা’ ভেঙে পড়তে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে বুশকে ইরাকে ইসলামিক ও সাদ্দামপন্থী বিদ্রোহী দমনে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছিল। কিন্তু বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ইরাকে অবাধেই চলতে থাকে।

ইরাক আগ্রাসনের পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বেশির ভাগ বিশ্লেষক সাংঘাতিক ভুল এবং গৃহযুদ্ধ, দুর্নীতি ও চিরশত্রু ইরানের হস্তক্ষেপের কারণে সৃষ্ট অস্থিতিশীল একটি দেশকে স্থিতিশীল করার ব্যর্থতার মতো বিষয়গুলো সামনে এনেছেন। কিন্তু খুব কমসংখ্যক বিশ্লেষক একটা বিষয়ের ওপর নজর দিয়েছেন। বলা চলে, শুরুর দিকে রাশিয়া ও চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে মূল্যায়ন করেননি। এই মূল্যায়ন করতে না পারার ব্যর্থতা পরবর্তী সময়ে সাংঘাতিক ভুলের জন্ম দেয়।

জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীরা একটা নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ব্যর্থতা যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে, সেটা তারা কখনোই বিবেচনা করবে না।

সৌদি আরবের বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। শুরু থেকেই এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়া সৌদি আরবের বিকল্প ছিল না। দেশটির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘আমরা এটা স্বীকার করে নিতে পারি না যে এই যুদ্ধ ইরাকের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করছে।’

সৌদি আরব তাদের বিমানঘাঁটি  যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক বদলে যেতে শুরু করে। ধীরে হলেও সুনিশ্চিতভাবেই সৌদি আরব চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে।  

ইয়েমেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত গেরাল্ড ফেয়ারস্টেইর বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যেটাকে ‘পরাশক্তির প্রতিযোগিতা’ বলে, তাতে নিজেদের জড়িয়ে না ফেলার ওপর জোর দিচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি আরব তাদের স্বার্থের জায়গাটি পরিষ্কার করেছে। তারা তাদের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার চীন এবং ওপেকপ্লাসে তাদের মূল সঙ্গী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে মনোযোগ দিচ্ছে।

এরপর রাশিয়া ও চীনের কথা বিবেচনা করা যাক। ইরাক যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দেশ দুটির দৃষ্টিভঙ্গি খোলনলচে বদলে দেয়। সেই পরিবর্তনই এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাটকীয় খেলা খেলছে।

১৯৯০-৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েত থেকে ইরাকের আগ্রাসন বাহিনী হঠাতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়া সহায়তা করেছিল। রাশিয়া তাদের আকাশপথ আমেরিকান সামরিক বিমান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছিল। ভ্লাদিমির পুতিনও একসময় আমেরিকার পরিকল্পিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন ছিলেন। এ কারণেই চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পুতিনের নির্মম যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা নরম সুরে সমালোচনা করেছিল।

পুতিন যেসব রাষ্ট্রকে বন্ধুরাষ্ট্র বলে বিবেচনা করেছে, তাদের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে জোরালোভাবে সুরক্ষা দিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার।

কিন্তু ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে, এমন একটি সরকারের ওপর হামলা বলে মনে করেছিলেন পুতিন। উপরন্তু, পুতিন সে সময় আমেরিকার একতরফা সিদ্ধান্তের প্রবণতা থামানোর পথ খুঁজছিলেন। পুতিন সে সময় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে কসাভোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।

২০০৩ সালের মার্চে পুতিন ইরাক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান। পুতিন বলেছিলেন, ‘আমরা যদি আন্তর্জাতিক আইনের বদলে জোর যার মুল্লুক তার নীতি প্রতিষ্ঠা করি, তাহলে যারা শক্তিশালী, তাদের যেকোনো কিছু করার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের মূল একটি নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেটা হলো রাষ্ট্রগুলোর অবিচ্ছেদ্য সার্বভৌমত্ব।’

এর পর থেকে পুতিন যেসব রাষ্ট্রকে বন্ধুরাষ্ট্র বলে বিবেচনা করেছে, তাদের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে জোরালোভাবে সুরক্ষা দিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার। রাশিয়ার জঙ্গি বিমানগুলো বিদ্রোহীদের আস্তানায় বোমা ফেলে আসাদের স্থলবাহিনী ও তাদের লেবানিজ মিত্রদের উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া আয়ত্তে নিতে সহায়তা করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে শূন্যতা তৈরি করে গেছিল, সেটা পূরণ করেছেন পুতিন। আমেরিকান বাহিনী সরে যাওয়ায় সেখানকার সব পক্ষকেই পুতিনকে সমর্থন দিয়েছেন। এ ছাড়া রাশিয়া ইউক্রেনে সম্প্রতি যে আগ্রাসন শুরু করেছে, সেখানে ইরান আগ্রহভরেই মস্কোকে ড্রোন দিয়েছে।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সীমাহীন ব্যর্থতা মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ২০১৩ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে, মধ্যপ্রাচ্য চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডস পরিকল্পনার অংশ। ২০২০ সালের মধ্যে চীন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের প্রধান আমদানিকারক।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে চীন একসময় কেবল কাছের প্রতিবেশী এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির ওপর মনোযোগ দিত, সেই চীন এখন বৈশ্বিক কূটনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক মেরামতে মধ্যস্থতা করেছে চীন। সৌদি আরব একসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ছিল। একইভাবে চীন এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে।

জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীরা একটা নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ব্যর্থতা যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে, সেটা তারা কখনোই বিবেচনা করবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

  • ডেনিয়েল উইলিয়ামস দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রতিবেদক