ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে। সেই সঙ্গে তারা ভোট গ্রহণের শেষ মুহূর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর সন্ত্রাসী হামলাকে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস বলে অভিহিত করেছে।
প্রশ্ন হলো সেই অপপ্রয়াসটি কারা করল? নির্বাচনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্বে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন, তাঁরাও তাদের ( কমিশনের) অধীন চলে যান। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যে রূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ সে ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্র কিংবা এর আশপাশে সংঘটিত অঘটনের দায়ও কমিশন এড়াতে পারে না।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। দেশের ভেতরে বিরোধী দল সমালোচনা করে বলেছে, যেই দল হিরো আলমকে সহ্য করতে পারে না, তারা কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে? জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়েছে। ঢাকা ১২টি দেশের রাষ্ট্রদূতেরা যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।
উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের খরা দেখে বীরবলের বিখ্যাত কাকের গল্পটি মনে পড়ল। বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের সভাসদের অন্যতম সদস্য। সম্রাট আকবর নানা বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিতেন। একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দিল্লি শহরে কত কাক আছে, বলতে পার বীরবল?’
অন্যদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি দেখেছেন ষড়যন্ত্র হিসেবে। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হয়েছে। টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। পুলিশ যাঁদের গ্রেপ্তার করেছে, তাঁরা সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত বলে খবর বের হয়েছে। তাহলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপনির্বাচনকে কারা প্রশ্নবিদ্ধ করল, কারা ষড়যন্ত্র করল সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে কেউ ষড়যন্ত্র করুক বা না করুক, ফলাফল দেখে গণতন্ত্রীকামী নাগরিকেরা প্রচণ্ড হতাশ হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে আওয়ামী লীগ ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বাক্সে ভোটের খরা দেখা দিল কেন? আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, উপনির্বাচনটি হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। এ জন্য ভোটারদের আগ্রহ কম ছিল। তাই বলে ১২ শতাংশেরও কম?
ভোটের ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিজয়ী হন ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে। তাঁর নিকটতম প্রার্থী হিরো আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট।
সহকর্মী রিয়াদুল করিম কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, অন্য এলাকার তুলনায় সেনানিবাস এলাকা (মানিকদী ছাড়া) ও কূটনৈতিকপাড়া হিসেবে পরিচিত বারিধারা এলাকায় এই দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান কম। এসব এলাকার ২৪টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ৭১৩ ভোট। হিরো আলম পেয়েছেন ৯২৭ ভোট। এসব কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার অন্য এলাকার তুলনায় কম ছিল।
কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম প্রথম আলোয় চমৎকারভাবে তাঁর ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তিনি একাধিক কেন্দ্র ঘুরেও তার ভোটার স্লিপ পাননি। কেন্দ্রের বাইরে থাকা সহায়তাকারীরা তাঁকে একটি স্লিপ দিয়ে ভেতরে পাঠান। তাঁরা যে স্লিপ দিয়েছেন, তার সঙ্গে আফসানার ছবি ও পরিচয়পত্রের নম্বরের মিল নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি ভোট দিতে পারেননি।
একটি বাদে সব কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন। কিন্তু মহাখালী ডিওএইচএসে অবস্থিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (পুরুষ ভোটার) কেন্দ্রে হিরো আলম তাঁর চেয়ে বেশি ভোট পান। এই কেন্দ্রে হিরো আলম পেয়েছেন ১১০ ভোট। মোহাম্মদ আলী আরাফাত ৭৯ ভোট। আরেকটি কেন্দ্রে আরাফাত ও হিরো আলম সমান সমান ভোট পেয়েছেন। এটা আওয়ামী লীগের ভূমিধস জনপ্রিয়তার প্রমাণ নয়।
নির্বাচন হলো প্রতিনিধি বাছাই করার উন্মুক্ত সুযোগ। ঢাকা-১৭ আসনের ভোটারেরা সেই সুযোগ পেয়েছেন? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি উপনির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু তারা নির্বাচন ঠেকাতে যায়নি। এলাকাবাসীকে ভোট দিতে বাধাও দেননি। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন বর্জন করেছে, ধরে নিচ্ছি, তাদের কর্মী ও সমর্থক ভোটারেরা ভোট দিতে যাননি।
কিন্তু ঢাকা-১৭এর আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকেরা কোথায় গেলেন? দেশের সবখানে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসমর্থন আছে বলে দলের নেতারা দাবি করেন। ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার বলে গুলশান-বনানী এলাকায় তাদের সমর্থন বেশিই থাকার কথা। কয়েক দিন আগে ব্যবসায়ীরা সদলবলে বিশাল আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করলেন।
উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের খরা দেখে বীরবলের বিখ্যাত কাকের গল্পটি মনে পড়ল। বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের সভাসদের অন্যতম সদস্য। সম্রাট আকবর নানা বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিতেন। একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দিল্লি শহরে কত কাক আছে, বলতে পার বীরবল?’
প্রশ্নটি শুনে বীরবল বললেন, ‘জাহাঁপনা, বর্তমান শহরে ৯ লাখ ৯ হাজার ৯৯৯টি কাক আছে। আপনার যদি সন্দেহ হয় তাহলে নিজে অথবা অন্য লোক দিয়ে গুনে দেখতে পারেন। যদি দেখেন এই সংখ্যা থেকে কিছু কম কাক আছে, তাহলে বুঝবেন দিল্লির আশপাশে বন্ধুদের সঙ্গে তারা বেড়াতে গেছে। আবার যদি দেখেন ওই সংখ্যা থেকে বেশি কাক আছে, তাহলে বুঝবেন তাদের বন্ধু বা আত্মীয়েরা অন্য এলাকা থেকে বেড়াতে এসেছে!’
ঢাকা-১৭-এর উপনির্বাচনের ফল দেখে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী ও সমর্থক ভোটার ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভোটের দিন অন্য কোনো শহর বা দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। না হলে দলের মনোনীত প্রার্থী কেন মাত্র ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হবেন?
এ বিষয়ে সত্য উদ্ঘাটনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একটি তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com