চাকরিপ্রত্যাশীদের কপালে আর কত লাঠিপেটা

চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের। শুক্রবার বিকেল পাঁচটায়।
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বাংলাদেশে এককভাবে সবচেয়ে বড় দল কোনটি? কেউ বলবেন, আওয়ামী লীগ, কেউ বলবেন বিএনপি। কিন্তু এদের চেয়েও বড় দল হলো বেকার। পৃথিবীর যেসব দেশে বেকারত্বের হার সর্বাধিক, তার মধ্যে বাংলাদেশ সামনের সারিতে। আর শিক্ষিত বেকারদের হার সম্ভবত বাংলাদেশেই সর্বাধিক।

চাকরিপ্রত্যাশী যুবপ্রজন্ম বহু বছর ধরে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সারা দেশে তাদের নেটওয়ার্ক আছে।  তাদের দাবি দাওয়ার মধ্যে আছে, আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের  নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর যে অঙ্গীকার করেছিল, সেটা বাস্তবায়ন করুক। দেশের পাঁচ লাখেরও বেশি বেকার আছে, যাদের বড় অংশের বয়স ৩০ বছরের বেশি। করোনাকালে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। চাকরির বয়সসীমা যখন ৩০ করা হয়, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। এখন গড় আয়ু হয়েছে ৭৩ বছর। তাহলে বয়সসীমা কেন বাড়ানো হবে না?  বিশ্বের ১৬২টি দেশে বাংলাদেশে চেয়ে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছরের বেশি। অনেক দেশে কোনো সীমা রেখা নেই। যে কোনো বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন।

সংগঠনের পক্ষ থেকে শুক্রবার সকালে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। একই দাবিতে তারা বিকেলে শাহবাগে সমাবেশ ডাকলে পুলিশ বাধা দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল সোয়া চারটার দিকে চাকরিপ্রত্যাশীরা জাদুঘরের সামনে থেকে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় শাহবাগ মোড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যানজট দেখা দেয়। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা অঞ্চলের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে বিকেল পাঁচটার দিকে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যের একটি দল শাহবাগ মোড়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের মারধর করে। এ সময় আন্দোলনকারীদের বেশির ভাগ ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশে সরে যান। কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পুলিশ আটক করে।

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ‘আমরা এসেছিলাম ইশতেহার বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে। পুলিশ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালিয়েছে। এমনকি নারীদের গায়ে পুলিশের পুরুষ সদস্যরা হাত তুলেছেন।’

আমরা নাকি উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের খোয়াব দেখছি। কিন্তু উন্নত দেশের সংজ্ঞাটা কী? যে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা যথাক্রমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের নিশ্চয়তা, কিন্তু সেই নিশ্চয়তা তারা কত মানুষকে দিতে পারেনি। বরং লেখাপড়া শিখে যাঁদের কর্মজীবন শুরু করার কথা, তাঁরা এখন চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পদে পদে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও অপমানিত হচ্ছেন।

ডেইলি স্টারের ছবিতে দেখা যায়, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এক তরুণকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন ও লাঠিপেটা করছেন। অন্য তরুণেরা তাঁকে বাধা দিয়েও আটকাতে পারছেন না। এই ছবি তোলার দায়ে পুলিশ কর্মকর্তা আলোকচিত্রীদেরও লাঞ্ছিত করে। এর আগের আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তা এক তরুণকে পিটিয়ে সড়কের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা। শাহবাগে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বেকার তরুণ-তরুণীদের ওপর লাঠিপেটা পেটা কেন?

উন্নয়নের মহা সড়কে চলা বাংলাদেশে বেকার তরুণেরা চাকরির দাবিতে রাস্তায়ও নামতে পারবেন না। এটা কেমন কথা। বেশ কিছু দিন ধরে আমরা দেখছি, যাঁদের দাবিদাওয়া ও প্রতিবাদ জানানোর অন্য কোনো জায়গা নেই, তাঁরাই শাহবাগে আসেন। মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন।
অনেকে বলেন, এটি ঢাকার হাইড পার্ক। জিয়াউর রহমানের আমলে সচিবালয়ের পূর্ব পাশে হাইড পার্কের আদলে মুক্তাঙ্গন বানানো হয়েছিল। আড়ম্বর করে মন্ত্রীরা উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সময়ে ঢাকায় সমাবেশ করার অনেক খালি জায়গা ছিল। এখন জায়গা নেই বলেই মানুষ প্রতিবাদ করতে শাহবাগে বা প্রেসক্লাবের সামনে আসেন। তা-ও পুলিশ তাঁদের দাঁড়াতে দেয় না।

আমরা নাকি উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের খোয়াব দেখছি। কিন্তু উন্নত দেশের সংজ্ঞাটা কী? যে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা যথাক্রমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের নিশ্চয়তা, কিন্তু সেই নিশ্চয়তা তারা কত মানুষকে দিতে পারেনি। বরং লেখাপড়া শিখে যাঁদের কর্মজীবন শুরু করার কথা, তাঁরা এখন চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পদে পদে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও অপমানিত হচ্ছেন।

চাকরিপ্রার্থী যুবপ্রজন্মের সদস্যরা সরকারের কাছে বিনা পরীক্ষায় চাকরি চাইছেন না। তাঁরা কেবল চাকরির পরীক্ষার সুযোগটি চাইছেন। এটি দিতে আপত্তি কোথায়। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে বললেন, চাকরিপ্রার্থীদের বয়সসীমা বাড়াবেন; আর নির্বাচন হয়ে গেলে ভুলে যাবেন, এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান কবে হবে? কবে বেকার তরুণেরা চাকরি পাবে? বলা হয়, ব্রিটিশরা এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল কেরানি বানানোর জন্য। আপনারা তো উচ্চতর কেরানিও বিদেশ থেকে ধার করে আনেন। তাহলে জেলায় জেলায় কেন বিশ্ববিদ্যালয় করছেন? কেন ফি বছর লাখ লাখ বেকার তৈরি করছেন? বেকার জীবন যে কত দুঃসহ, বেকার ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেন না। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তাঁরা মা-বাবার কাছে টাকা চাইতে পারেন না। সব মা-বাবার দেওয়ারও সামর্থ্য নেই। ধার করে, জমিজমা বিক্রি করে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান।

উচ্চশিক্ষিত বেকারদের একাংশ চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করছে। আরেক অংশ বিদেশে গিয়ে সাগরে ডুবে মরছে কিংবা মরুভূমিতে হারিয়ে যাচ্ছেন। ধরা পড়ে অনেকে নির্যাতন শিবিরে আটকা পড়ছেন।

দেশের ভেতরে ন্যূনতম কিছু করার থাকলে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যেতেন না। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষা বলছে, কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এ খাতে কাজ করেন। আইএলওর গবেষণার তথ্য হলো, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ।

এ অবস্থায় চাকরির বয়সসীমা নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। ২০২০ সালের শুরুতে যাঁদের বয়স ছিল ৩০, সরকারি নিয়মানুযায়ী সেটাই ছিল চাকরির দরখাস্ত করার শেষ সময়। এখন আর তাঁরা দরখাস্ত করতে পারছেন না। ইতিমধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কয়েকটি ব্যাচের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। কারও যোগ্যতা থাকলে চাকরি হবে, না থাকলে হবে না। কিন্তু করোনার কারণে যাঁদের জীবন থেকে দেড়-দুই বছর অপচয় হলো, তাঁদের চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগটি দিতে হবে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com