মতামত

সাম্প্রদায়িক উস্কানি: শ্রীমঙ্গল যেভাবে প্রতিরোধের পথ দেখাল

গত ২৭ আগস্ট বেলা ১১টা। শ্রীমঙ্গল চৌমোহনায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারে সংহতি সমাবেশ। নেতৃত্ব দিচ্ছেন রিয়াজ খান ও প্রীতম দাশরা। ছোট সংগঠন, লোকবলও তেমন নেই। শ্রমিকেরাও যথারীতি আসতে শুরু করেছেন। প্রথমে পুলিশ সদস্যরা এলেন। মুঠোফোনে ছবি তুললেন। তাঁদের সামনেই ফোন করলেন সরকারদলীয় ছাত্রনেতাদের। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে আমরা এমনটাই দেখতে পাই।

লাউয়াছড়া থেকে চুনারুঘাট, করোনা থেকে বন্যায় সর্বত্র ছিলেন প্রীতম দাশদের মতো তরুণেরা। উপজেলা নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন এক চা–শ্রমিককে। গত বন্যায় বন্যার্ত মানুষের পাশে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন, এবারও তেমন দাঁড়িয়েছিলেন চা–শ্রমিকদের পাশে। তাই তেমন সাড়া পেলেন না পুলিশের লোকজন। এদিকে অনেকেই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এভাবে কাটল ৪৫ মিনিটের মতো। হঠাৎ পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের আবেদ হোসেন (স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী) নেতৃত্বে ৫০–৬০ জনের একটা দল চড়াও হয় তাঁদের ওপর। আহত হন রিয়াজ খান, তাঁর মাথা ফেটে যায়। বাঁ হাতের কবজিতে আঘাত পান প্রীতম। ছোটখাটো আঘাতে আহত হন আরও ১০ জন। সেদিনই বিকেল ৪টায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার দুটি প্রেসক্লাবেই সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। সেখানে হামলাকারীদের নাম ও পদবি উল্লেখ করেন এবং গ্রেপ্তারের দাবি জানান। ২৮ আগস্ট রংপুর, রাজশাহীসহ বিভাগীয় শহরগুলোয় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ২৯ ও ৩০ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে আবারও সংবাদ সম্মেলন হয়। নিন্দার ঝড় ওঠে। কোণঠাসা হয়ে পড়েন হামলাকারীরা।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের আহত নেতা–কর্মীরা

২.

প্রীতম দাশ উর্দু গল্পকার সাদাত হোসেন মান্টোর একটি সাক্ষাৎকারের টুকরো–অংশ ৮ জুলাই, ২০২২ তারিখে পোস্ট করেন। এটি তিনি নিয়েছিলেন তার আগের দিন প্রকাশিত জাগো নিউজের কলাম থেকে। কলামটির নাম ছিল ‘নও পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ’। লিখেছেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।

তারপর সেই স্ক্রিনশট নিয়ে আগের দিনের হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা মাহবুব আলম ভূঁইয়া, মামুন আহমেদরা ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত ১টায় প্রচার শুরু করে দেন। সঙ্গে যোগ দেয় সাম্প্রদায়িক হামলায় ইচ্ছুক একটি চক্র। পরদিন ৩১ আগস্ট আসরের পর স্থানীয় বড় মসজিদ থেকে শহরে তারা মিছিলও করে। সেখান থেকে তারা প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তারের দাবিতে আলটিমেটাম দেয় যে শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর, ২০২২) জুম্মার নামাজের আগে গ্রেপ্তার করা না হলে সব মসজিদ থেকে একযোগে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে। আর সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের।

শ্রীমঙ্গল কি বাংলাদেশের বাইরে? এর আগে ঘটে যাওয়া কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকানো গেল না কেন? অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম ফেসবুকে বলেছেন, ‘সমসাময়িক বাংলাদেশে একমাত্র শ্রীমঙ্গলই সাম্প্রদায়িক হামলার একটি পরিকল্পিত ছক আপাতত ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে।’

৩.

তারপর ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। থানা থেকে প্রীতম দাশকে দেখা করতে বলা হয়। মা–বাবাকে ক্ষমা চাইতে বলেন কেউ কেউ। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ঢাকায় বৃহস্পতিবার সংগঠনের অফিসে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে তারা ছাত্রলীগ ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গলে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির অপচেষ্টার অভিযোগ তোলে এবং ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেপ্তারসহ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। বলা হয়, ‘বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীর যেমন, তেমন চাকমা-মারমা-বাঙালিসহ সব জাতির। বিভাজনের নোংরা ফাঁদ ছিঁড়ে ফেলুন।’ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।

স্থানীয়ভাবে মসজিদগুলোর ইমামরাও এ ব্যাপারে এক মত হন যে, তাঁরা এখানে ধর্মীয় অবমাননা মনে করছেন না। এটাকে তাঁরা রাজনৈতিক ব্যাপার বলে চিহ্নিত করেন। ফলে মসজিদগুলোতেও প্রতিরোধ দাঁড়িয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক উসকানির মিছিলটিতে যোগ দেওয়া থেকে তাঁরা বিরত থাকেন।

অন্যদিকে ডিসি ও ইউএনও ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটি প্রীতম দাশ ও তাঁর পরিবারকে অন্তত ফেসবুকে এসে সরি বলতে বলে। কিন্তু প্রীতম ও তাঁর পরিবার সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশও বিষয়টি বুঝতে পারে এবং সাম্প্রদায়িক কোনো অস্থিরতা হোক তারা চায়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেদিন জুমার নামাজে মসজিদে উপস্থিত হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ব্যাপারে মুসল্লিদের আহ্বান জানান।

৪.

শ্রীমঙ্গল কি বাংলাদেশের বাইরে? এর আগে ঘটে যাওয়া কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকানো গেল না কেন? অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম ফেসবুকে বলেছেন, ‘সমসাময়িক বাংলাদেশে একমাত্র শ্রীমঙ্গলই সাম্প্রদায়িক হামলার একটি পরিকল্পিত ছক আপাতত ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে।’

মনোবিজ্ঞানী পাভলভ জানিয়েছেন, উদ্দেশ্য পূরণের পথে বারবার বাধা পড়লে রিফ্লেক্স অব পারপাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে নিভে যেতে পারে। উপবাস করতে বাধ্য হলে যেমন কয়দিন পর খিদে চলে যায়। খাবারের প্রতিক্রিয়া আর থাকে না। ঠিক তেমনি একবার সাম্প্রদায়িক হামলার জিগির শুরু হলে প্রতিরোধহীনতা দেখতে দেখতে তার প্রতিক্রিয়াও ক্ষীণ হয়ে আসে। প্রতিরোধ শূন্য হয়ে আসে। বিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত হয়। ফল না পেতে পেতে এই সর্বগ্রাসী বিচ্ছিন্নতা হয়েছে। ফলে সাম্প্রদায়িক হামলার পরিবেশ তৈরি হলেই তা আর ঠেকানো যায় না। অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলোও ভয়ে পিছিয়ে যায়।

সমাজের মধ্যে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ থাকেই। মসজিদের ইমামরাও তেমন মানুষ। ফলে কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে সবাই ঘটনাটি বুঝতে পারেন। দরকার শুধু তার সামনে সত্যটা তুলে ধরা। রক্ষণশীল ব্যক্তিও সত্য বোঝার ক্ষমতা রাখেন। সবচেয়ে বড় সত্য, রাষ্ট্র চাইলে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, নইলে হয় না। আজকের বাস্তবতা এই, কেউ যখন কাউকে গালিও দেন, তখনো সে রাষ্ট্রক্ষমতার বলেই দেন। ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাওয়া তাই জরুরি। শুধু রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানানো নয়, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথাবার্তায়, সম্পর্ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার ছক গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, শ্রীমঙ্গলে এই উদাহরণের সৃষ্টি হলো।

মনোবিজ্ঞানী পাভলভই বলেছেন, ‘মরে যাওয়া ক্ষুধাকেও জাগিয়ে তোলা যায়। জীবন যখন শুকিয়ে যায়, তখনো।’ রাষ্ট্র ও সমাজের ভেতরকার রাজনীতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা এবং জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলে তা সম্ভব। সাহস করে এগিয়ে গেলেই তা সম্ভব। সিলেটের শ্রীমঙ্গল আমাদের সেই সাহস ফিরিয়ে দিল।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক। ইমেইল: nahidknowledge@gmail.com