ট্রাম্পের আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সমানে অসংযত কথা বলেন এবং স্পষ্ট মিথ্যাচার করেন।
ট্রাম্পের আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সমানে অসংযত কথা বলেন এবং স্পষ্ট মিথ্যাচার করেন।

মতামত

‘পাগল’ ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে দুই ভাগ করে ফেলছেন

ডোনাল্ড ট্রাম্প কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? আপনি পাগলামিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন, তার ওপর এ প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে। তবে যেহেতু মঙ্গলবারের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নির্বাচিত হওয়ার আশা করছেন, সেহেতু এ প্রশ্নের জবাব জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পের অসংলগ্ন আচরণ ও কথাবার্তার জন্য ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে ‘আজব’ ও ‘অস্থির’ লোক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কমলা হ্যারিস গত সপ্তাহে আবারও ট্রাম্পের নির্বাচনের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কমলা তাঁকে একজন প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ট্রাম্প ক্ষমতার লোভে আচ্ছন্ন এবং তিনি ক্ষমতা পেলে সেটি সবার জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে।

ট্রাম্পের সমালোচনা করতে গিয়ে কমলা হ্যারিস তুলনামূলকভাবে শালীন ছিলেন। সে জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। যদিও কেন তিনি ট্রাম্পের সমালোচনায় তুলনামূলকভাবে নমনীয় ছিলেন, তা বোঝা কঠিন। কারণ, ট্রাম্প প্রথম থেকে তাঁকে চরম অবজ্ঞা ও হেয় করে এসেছেন।

এমনিতে ট্রাম্পের মানসিক সুস্থতা নিয়ে আরও সহজ ভাষায় প্রশ্ন তোলা যায়: ট্রাম্প কি সম্পূর্ণরূপে তাঁর মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলেছেন? তাঁর মাথায় কি বাদুড় এসে বাসা বেঁধেছে? যদি তিনি অস্থিরমতির হয়ে থাকেন, তিনি যদি পূর্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন না হয়ে থাকেন এবং কল্পনার জগতে বাস করেন, তাহলে তাঁর মাথা ঠিক আছে কি না, তা ভোটার এবং বাকি বিশ্বের জানার অধিকার আছে।

ট্রাম্পের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কমলা হ্যারিসের এ মূল্যায়ন কোনো মানসিক রোগের একটি নিরপেক্ষ রোগ নির্ণয় নয়। এটি একজন সাধারণ মানুষের সরল প্রতিক্রিয়া, যা ট্রাম্পের অস্বাভাবিক আচরণ ও মন্তব্যগুলোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত বলে মনে হয়।

গত সপ্তাহে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা যে উন্মত্ত প্রচারাভিযান চালিয়েছেন, তার সঙ্গে নাৎসিদের নুরেমবার্গ সমাবেশের মিল আছে। এ কারণে ট্রাম্পের মানসিক সুস্থতা নিয়ে আবার বিতর্ক জেগে উঠেছে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্য ডেঞ্জারাস কেস অব ডোনাল্ড ট্রাম্প বইয়ে ২৭ জন মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী অনেকগুলো সতর্কসংকেত দিয়েছিলেন। সে বইয়ে যাঁরা মত দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বলেছিলেন, ট্রাম্প স্পষ্টতই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্ট; একই সঙ্গে তিনি একজন অত্যন্ত আবেগের বশবর্তী, অহংকারী, অজ্ঞ, বিশৃঙ্খল, নৈরাজ্যবাদী, আত্মমুখী ও স্বার্থপর ব্যক্তি।’

সাত বছর আগে দেওয়া সেই মানসিক বিশেষজ্ঞের মতামত এখনো সঠিক ও প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; এখন এ প্রশ্নও সামনে আসছে—তবে কি পাগল রাজা জর্জের (যাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ট্রাম্প অনুসরণ করতে চান) মতো ‘রাজা’ ট্রাম্পের উন্মাদনাও আরও খারাপ দিকে যাবে?

শব্দচয়নের মানদণ্ডে বিচার করলে ট্রাম্পের অসভ্য ও অভব্য ভাষা থেকে বোঝা যায়, তাঁর মানসিক অস্থিরতা অবনতির দিকে গেছে। প্রবীণ হোয়াইট হাউস পর্যবেক্ষক পিটার বেকার লিখেছেন, ট্রাম্পের ভাষণগুলো দিন দিন আরও অশালীন হয়ে উঠছে। এ কারণে তিনি ট্রাম্পকে ‘গালিগালাজের প্রেসিডেন্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

পিটার লিখেছেন, ‘ট্রাম্প শুধু ২০২৪ সালেই চার অক্ষরের অশ্লীল শব্দটি জনসমক্ষে উচ্চারণ করেছেন অন্তত ১ হাজার ৭৮৭ বার।’ তাঁর বিশ্লেষণ অনুসারে, ট্রাম্প ২০১৬ সালের চেয়ে ৬৯ শতাংশ বেশি এই ভাষা ব্যবহার করছেন। তিনি কমলা হ্যারিসকে ‘নোংরা ভাইস প্রেসিডেন্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাঁকে ‘বুদ্ধিতে খাটো মেয়ে মানুষ’ বলেও উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে তিনি যা যা বলেছেন, সেগুলোর অর্থ কী, তা তিনি ভালোভাবেই জানেন।

অশালীন ভাষা প্রয়োগ যদিও মোটেও মানসিক রোগের প্রমাণ নয়; তবে এটিকে রোগের উপসর্গ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম অভিধান ‘মেরিয়াম-ওয়েবস্টার’–এ উন্মাদ ব্যক্তিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, একজন উন্মাদ ব্যক্তি ‘যুক্তি ও বিবেকের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হন না এবং যুক্তিযুক্ত উপায়ে চিন্তা করতে অক্ষম’। ট্রাম্প যখনই মুখ খোলেন, তখনই তিনি এ সংজ্ঞায় নিজের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করেন। এ সংজ্ঞা তাঁর ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য হয়ে ওঠে।

ট্রাম্পের আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সমানে অসংযত কথা বলেন এবং স্পষ্ট মিথ্যাচার করেন। এগুলো এলোমেলো মস্তিষ্কের মানুষের সংজ্ঞায় পড়ে।

আরও একটি সংজ্ঞা প্রমাণ করে, ট্রাম্প নিঃসন্দেহে উন্মাদ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজন উন্মাদ ব্যক্তি প্রায় সব সময় অতিমাত্রায় অসন্তুষ্ট, ক্রুদ্ধ ও তিরিক্ষি মেজাজে থাকে। ট্রাম্পের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

তিনি সব সময়ই ‘তীব্রভাবে ক্রুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট’ থাকেন। যে ব্যক্তি সব সময় ক্ষিপ্ত মেজাজে থাকেন, তাঁকে তাঁর পাশে থাকা লোকের কাছে ‘ভয়ানকভাবে পাগল’ মনে হতে পারে। আর এ ধরনের বদমেজাজ যে কাউকে পাগল করে তুলতে পারে। মানুষ বৃদ্ধ বয়সে এলে সাধারণত মেজাজ তিরিক্ষি হয়। ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা ঘটতেই পারে। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, বার্ধক্যই তাঁর বিবেচনাবোধ হ্রাসের প্রাথমিক কারণ?

ট্রাম্প ভুলভাল কাজ করেন, ভুলভাল বলেন, কোথায় আছেন তা ভুলে যান এবং ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলেন। বাইডেনের ক্ষেত্রেও এটি হয়। তবে বাইডেনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হলো, বাইডেন নিছকই একজন ভুলভাল বলা বৃদ্ধ; আর ট্রাম্প হচ্ছেন নির্জলা উন্মাদ।

ট্রাম্প বিশ্বাসযোগ্য মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা দিতে বা তাঁর চিকিৎসার রেকর্ড প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন। গত মাসে ২৩০ জনের বেশি স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ তাঁকে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আরও স্বচ্ছ হতে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরা উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমরা সবাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিচক্ষণতা হারাই এবং মৌলিক প্রবৃত্তির দিকে ফিরে যাই। আমরা এটি ট্রাম্পের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। কারণ, তিনি তাঁর সমাবেশগুলোয় অন্যকে কটাক্ষ করতে কোনো ভব্যতার ধার ধারেন না।’

এটি সম্ভবত ট্রাম্পের শৈশবকাল থেকে এসেছে। একটি তত্ত্ব বলে, ট্রাম্প মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে একদিকে হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং অন্যদিকে নিজেই একজন হয়রানি সৃষ্টিকারী হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের মানুষ সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন।

যদি ট্রাম্প নিজের জগতে থেকে উন্মাদ হয়ে যেতেন, তাহলে সমস্যা হতো না। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি জাতীয় স্তরে প্রতিদিন অসুস্থ মানসিকতার প্রদর্শন ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পাগল বানাচ্ছেন। ভক্ত ও শত্রু—উভয়কেই তিনি অস্থির করে তুলছেন। তিনি সবাইকে—ডান ও বামপন্থী উভয় পক্ষকে—খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একে জাতীয় বিকৃতি সিনড্রোম (এনডিএস) বলা যেতে পারে।

এই সামষ্টিক উন্মাদনা ও গণ–উন্মত্ততা সর্বগ্রাসী এবং সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক। যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটে, তা যেমন সারা বিশ্বে প্রতিধ্বনিত হয়, তেমনি ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী উন্মত্ত দুনিয়া বাকি দুনিয়াকে অস্থির করে তুলবে। এটিই সবচেয়ে ভয়ের কথা।

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সাইমন টিসডাল দ্য অবজারভার–এর পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক