স্বাস্থ্যব্যয়ে উচ্চ হারের লাগাম টেনে ধরার পথ কী

স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ক্রমাগতভাবে বেড়েই যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হয়, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৫৪ হাজার কোটি।

তবে দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা বাবদ যে বিশাল পরিমাণ টাকা খরচ করছে, তা হিসাবে আনলে এ অঙ্ক আরও অনেক বড় হবে। ১৯৯৭ সালে এ ব্যয় ছিল ৫৬ শতাংশ, যা বেড়ে ২০১২ সালে ৬২ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ৬৭ শতাংশে দাঁড়ায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৪ শতাংশ খরচ হয় ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কেনা বাবদ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি। তবে হাসপাতালের আন্তবিভাগীয় রোগীর ওষুধের খরচ হিসাবে আনলে ওষুধ বাবদ খরচের অঙ্ক আরও বেশি হবে।

আন্তবিভাগীয় রোগীর খরচ বাবদ ব্যয় হয় ১০ শতাংশ, যার মধ্যে রয়েছে ওষুধ, ডায়াগনস্টিক সেবা, হাসপাতালের বেড বা কেবিন চার্জ এবং সার্জারি-সংক্রান্ত খরচ। অন্যদিকে, ব্যক্তির মোট ব্যয়ের প্রায় ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ বহির্বিভাগীয় রোগীর জন্য ডাক্তারের ফিসহ অন্যান্য খরচ বাবদ এবং ১১ দশমিক ৭ শতাংশ ডায়াগনস্টিক সেবার জন্য ব্যয় হয়।

এ পরিসংখ্যান থেকে সহজে বোঝা যায়, স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তির খরচের লাগাম টেনে ধরতে হলে ওষুধ বাবদ ব্যয় কমাতে হবে। ওষুধ বাবদ উচ্চ ব্যয়ের মূলে একদিকে যেমন রয়েছে গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপসহ ওষুধনির্ভর বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ক্রমবর্ধমান উচ্চ হার; পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমের ওপর নানা অনাচারের ফলে নতুন নতুন সংক্রমণ ও অসংক্রামক রোগের আবির্ভাব। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রচণ্ড অসচেতনতার পাশাপাশি অত্যধিক মাত্রায় বায়ু, পানি, শব্দ ও প্লাস্টিক দূষণ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে ওঠা এবং শহর অঞ্চলে খেলার মাঠ, পার্ক, পাবলিক টয়লেটের অনুপস্থিতি, সমাজ থেকে খেলাধুলা কমে যাওয়া ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে ভেজাল ও দূষিত খাবারে বাজার সয়লাবসহ নানাবিধ কারণে মানবশরীরে বিভিন্ন প্রকার প্রাণঘাতী অসুখ-বিসুখ দানা বাঁধছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ইনজুরি এবং পঙ্গুত্ব বরণ।

এ ছাড়া মুঠোফোনে আসক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের মাদকের ভয়াবহ বিস্তৃতির ফলে কিশোর-কিশোরী এবং যুবসমাজের একটি বড় অংশ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। এককথায় আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ডে স্বাস্থ্যকে সর্বদা বলি দিচ্ছি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকে এক নম্বর গুরুত্বে না আনতে পারলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে।

প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে সব ফার্মেসি ও ড্রাগ স্টোরকে ডিজিটাল সিস্টেম ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোন ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বিক্রেতা ও ক্রেতাকে ট্র্যাকিং ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ওষুধ ব্যবহারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ঔষধ প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

তাই জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যকে এক নম্বর গুরুত্বে আনতে সব মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে সুস্বাস্থ্য গঠনে জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ক্যাবিনেট ডিভিশনের অধীন একটা স্বতন্ত্র শাখা বা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে।

ওষুধের খরচ বাবদ উচ্চ ব্যয়ের মূলে অন্যদিকে রয়েছে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার। আর এর মূলে রয়েছে সেলফ-মেডিকেশন ও গ্রাম্য ডাক্তার এবং ওষুধের দোকানের বিক্রেতা কর্তৃক অযাচিত প্রেসক্রিপশন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এমবিবিএস ডাক্তার কিংবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের দেখা পাওয়া যায়। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের বেশি ওষুধ সেবনের অত্যধিক প্রবণতা। সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবার অর্থই কেবল ওষুধ সেবন। আমরা মুড়িমুড়কির মতো ওষুধ সেবন করছি।

ওষুধের চাহিদা বেশি থাকায় দেশের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো লাখ লাখ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে। মুদিদোকানেও এখন ওষুধ পাওয়া যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ওষুধই আমাদের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। ওষুধ সেবন সম্পর্কে জনমানুষের এ ভ্রান্ত ধারণা বন্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রেসক্রিপশন অডিট চালুকরণ এবং সব ফার্মেসি ও ড্রাগ স্টোরকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে।

প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে সব ফার্মেসি ও ড্রাগ স্টোরকে ডিজিটাল সিস্টেম ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোন ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বিক্রেতা ও ক্রেতাকে ট্র্যাকিং ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ওষুধ ব্যবহারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ঔষধ প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

অন্যদিকে রয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেশি বেশি ওষুধ বিক্রির প্রবণতা। জনগণের প্রয়োজন হোক বা না হোক, ওষুধ কোম্পানিগুলোর টার্গেট ওষুধের বিক্রি বাড়ানো। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে এবং তা বিক্রির জন্য অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংসহ নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। একই কোম্পানি একাধিক থেরাপিউটিক গ্রুপের একাধিক ওষুধ উৎপাদন করছে। বর্তমানে রেজিস্ট্রিকৃত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সংখ্যাই ৩৩ হাজারের বেশি।

ফলে জনগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করছে, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সসহ জনস্বাস্থ্যকে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তাই যেকোনো মূল্যে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলেও বেশির ভাগ ওষুধের মূল্য ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে, যা ইন্ডিকেটিভ প্রাইজ হিসেবে অভিহিত হয়।

তবে ওষুধ কোম্পানিগুলো যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে জন্য বর্তমান মার্কআপ যুক্তিসংগতভাবে পরিবর্তন করা যেতে পারে। ফলে অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং বন্ধ হবে এবং ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমবে। অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান উন্নয়নে বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স টেস্ট পদ্ধতি চালু করতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ওষুধ উৎপাদন, বিপণন, প্রেসক্রিপশন ও সেবনে স্মার্ট হতে হবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়