নির্বাচনের পর পাকিস্তানে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে
নির্বাচনের পর পাকিস্তানে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে

পাকিস্তানে ভোটারেরা সেনা কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে

উপমহাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনের কারণে ২০২৪ সাল নির্বাচনের বছর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উপমহাদেশে নির্বাচনের মৌসুম শুরু হয় গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে বিরোধী দলবিবর্জিত নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে সরকারি দল ও সরকারি দলের অনুগ্রহ পাওয়া জাতীয় পার্টি আসনের দিক দিয়ে দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পেরেছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গঠন করা দলের অস্তিত্ব কার্যত বিলুপ্তির দিকে এগিয়েছে। সংসদে এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ আর তাদের অনুগ্রহ পাওয়া কথিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কোনো দল নেই। অবশ্য সরকারি দলের কৃপায় কল্যাণ পার্টির একজন সংসদে রয়েছেন। এই নির্বাচনের ফলাফল আর এর সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।

শুরুতেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও আজকের লেখার বিষয় হলো উপমহাদেশ তোলপাড় করা ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সব সময়ই সামরিক বাহিনীর বড় প্রভাব ছিল ও আছে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের যে সংস্কৃতি পাকিস্তানে শুরু হয়েছিল, প্রথমবারের মতো তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনপরবর্তী ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওই বিপর্যয়ের পর ধারণা করা হয়েছিল যে দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের ইতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সরিয়ে জিয়াউল হকের ক্ষমতা দখল, পরে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার পর দু–দুবার সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে তাদের ভূমিকাকে আরও জোরদার করেছে।

তবে সোভিয়েত-আফগান সংঘাত-উত্তর পরিবর্তিত বিশ্বে পাকিস্তানেও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও দৃশ্যত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৮ সালের পর থেকে দৃশ্যত সর্বজনীন নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর পছন্দ-অপছন্দ ও কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি মোটেও গোপন ছিল না এবং এখনো নয়।

অনেকেই মনে করেন যে এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাওয়া ও তরুণ পাকিস্তানিদের আইকন হিরো ইমরান খানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সে বছর ১১৭ আসনে বিজয়ী হয়ে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), মুসলিম লিগ (কিউ) ও কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্যকে নিয়ে সরকার গঠন করে। যেহেতু জোট সরকার, তাই এর ভিতও ছিল দুর্বল। চার বছরের মাথায় ২০২২ সালে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান সরকারের পতন হয়। তখন পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থাও বেশ শোচনীয়।

বলা হয়ে থাকে যে ইমরান খানের সরকারের পতনের পেছনে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিনটিতে তাঁর রাশিয়া সফরের বিষয়টি কাজ করেছে। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব নাখোশ হয়েছে। তবে যাঁরা পাকিস্তানের রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সেই পেছনের শক্তির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের ধারণা অবশ্য ভিন্ন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ধারণা করি যে ভুট্টোর মতো ইমরানও চেয়েছিলেন রাজনীতিতে সেনা প্রভাব কমানোর কিছু পদক্ষেপ নিতে। সেটাই তাঁর জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান সেনা তথা সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা নিয়ে সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।

দৃশ্যত আইএসআইপ্রধানের নিয়োগ নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধ চরমে ওঠে। এর বাইরে আরও যে বিষয় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়, তা হচ্ছে রাজস্ব বিভাগের উদ্যোগে সেনাপ্রধান আর তাঁর স্ত্রীর কথিত প্রচুর সম্পদের খোঁজখবর নেওয়ার ঘটনা। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর কথিত বিখ্যাত পত্র আসে বলে জানা যায়। এখন শোনা যাচ্ছে ডোনাল্ড লু এ বিষয়ে সিনেট কমিটির তলবে ব্যাখ্যা দেবেন।

ওপরের পটভূমিতেই ইমরান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে এমকিউএম। ইমরান খানের বিশাল জনপ্রিয়তার বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি ইমরানের বিরোধীরা, এমনকি পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারকেরাও। ইমরানকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি রয়েছে, যার প্রমাণ এবারের নির্বাচনের পোস্টাল ভোট, যেখানে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সেনা সদস্য ইমরান-সমর্থিত সদস্যদের ভোট দিয়েছেন।

ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খানের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, পাকিস্তানের ঘুণে ধরা রাজনীতি ও সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারা ও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা। পুরো পাকিস্তানে মধ্যবয়সী থেকে তরুণদের মধ্যে ইমরান ও পিটিআইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে।

বলা যায়, এবারের নির্বাচনে একাত্তর–পরবর্তী পাকিস্তানে এই প্রথমবারের মতো রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন দেশের ভোটাররা। ইমরান হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম নেতা। গত সরকারের সময় মেয়াদ পুরো করতে পারলে তিনি এত জনপ্রিয় হতেন কি না, সন্দেহ রয়েছে। তাঁকে জোর করে ক্ষমতা থেকে নামানোর কারণেই মানুষ ফুঁসে উঠেছে এবং তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।

ইমরান খানকে হাস্যকরভাবে ১৪ ও ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া, তাঁকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া, তাঁর দলের প্রার্থীদের দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না দেওয়া এবং প্রতীক থেকে বঞ্চিত করার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে তারা যে ফলাফল দেখিয়েছে, তা ইমরান খানের জনপ্রিয়তার পর্যায়কেই তুলে ধরে। দল হিসেবে না হলেও ইমরানের সমর্থক প্রার্থীরাই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

ইমরান–সমর্থিত প্রার্থীদের হারাতে না পেরে রিটার্নিং কর্মকর্তার পর্যায়ে যে ফলাফল বদলানো হয়েছে, তার সত্যতা আদালতের বাইরে প্রমাণিত হতে চলেছে। রাওয়ালপিন্ডি ডিভিশনের একজন কমিশনার প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে তাঁর আওতাধীন অঞ্চলে ফলাফল পরিবর্তন করে ইমরান–সমর্থিত প্রার্থীর বদলে অন্যদের জেতানোর বিশদ বিবরণ দিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তিনি এসব কাজে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, এমনকি প্রধান বিচারপতিও যুক্ত বলে অভিযোগ করায় পাকিস্তানজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিবেকের দংশনে আরও কোনো কোনো কর্মকর্তা একই পথ ধরলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে পাকিস্তানের এই নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ে, বিশেষ করে ভোটকেন্দ্রে কোনো বড় ধরনের কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। কারণ, প্রতিবাদের অংশ হিসেবে বিপুলসংখ্যক পিটিআই সমর্থক ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। তা ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ের ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশাত্মবোধ ও সততার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণে কেন্দ্র থেকে পাওয়া ফলাফলকে রিটার্নিং কর্মকর্তার পর্যায়ে নির্লজ্জভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দারা এ কাজে যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাকিস্তানের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশটি যে গভীর রাজনৈতিক ঝড়ের মধ্যে পড়েছে, তার একটি ইতিবাচক ও আশার দিক হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর দৌরাত্ম্য কমার একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তা না হলে পাকিস্তান ১৯৭১ সালের চেয়ে গভীর সংকটে পড়তে পারে, যা উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য সুখকর নয়। তবে পাকিস্তানের নির্বাচন উপমহাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর বড় ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা শুরুতেই আলোচনা করেছি। সামনে ভারতের নির্বাচন। গণতন্ত্রের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারতও আগের থেকে পিছিয়েছে, যা উদার গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

hhintlbd@yahoo.com