ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে
ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে

মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্য কি বিপন্ন

সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন শেষ হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে বলে দাবি করা হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রভাবশালী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। ১৯৪৭ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে ১ আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করেছিল আইএমএফ। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার–সংকট বা সোনার সংকটের’ সময় ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ে। সোনার দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। এর ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’। এ ব্যবস্থায় সোনার দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেমের কারণে ক্রমেই সারা বিশ্বে পরম শক্তিশালী হয়ে ওঠে মুদ্রা বেচাকেনার বাজার। তথ্যপ্রযুক্তি-বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারে ১৯৭২ সাল থেকে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।

সাম্রাজ্যবাদকে রুশ বিপ্লবের স্থপতি ভ্লাদিমির লেনিন অভিহিত করেন ‘পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’। রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বে সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক নাম হলো ‘স্টেট মনোপলি ক্যাপিটালিজম’ বা রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ। একচেটিয়া পুঁজিবাদ শক্তি সঞ্চয়ের এক পর্যায়ে যখন রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করে, তখন রাষ্ট্রগুলো ওই একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশ দখলের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়।

সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়েই মানবজাতিকে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ উপহার দিয়েছে সাম্রাজ্যের অধিকারী দেশগুলো। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি উপনিবেশের মালিক, যাদের তুলনায় জার্মানির উপনিবেশ ছিল অনেক কম। কারণ, জার্মানি ১৮৭০ সালে যখন একত্রীকরণের মাধ্যমে একক দেশ হিসেবে গঠিত হয়েছিল, তখন পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বিশ্বের বেশির ভাগ উপনিবেশের ওপর নিজেদের দখলদারি পাকাপোক্ত করে ফেলেছিল এবং উপনিবেশগুলোর ভাগ-বাঁটোয়ারাও প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল।

নিজেদের ভাগে আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর ভাগ-বাঁটোয়ারা বাড়ানোর জন্য জার্মানি ১৮৮৬ সালে বার্লিন কনফারেন্সের আয়োজন করলেও তারা সফল হতে পারেনি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথ কূটচালের কারণে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানি ওই অবস্থানের পরিবর্তন করতে চেয়েছিল কিন্তু ১৯১৮ সালে তাদের শোচনীয় পরাজয় ওই উদ্দেশ্যকে ভন্ডুল করে দিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের যে অপমানজনক বোঝা ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটাই জার্মান জাতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই যুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে। প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে।

তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে এখন পর্যন্ত আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য পরনির্ভরতার’ জালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টস বা লেনদেনের ভারসাম্যের চলতি হিসাবে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক।

উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে। চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই একক আধিপত্যের কারণে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলারপ্রতি সরকারি হিসাবে ৪ দশমিক ৭৬ টাকা হলেও খোলাবাজারে ছিল ১৫ টাকা। এখন এক ডলারের বাজারদর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা আর খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২২ টাকায়। গত আড়াই বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে।

অথচ আমরা ডলারের দাম নির্ধারণে এখনো ‘ফ্রি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ বা বাজারের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতি চালু করিনি। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি এখন অনুসরণ করছি। এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমেই আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ (পাকিস্তানে এক ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।

আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশি মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে, তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে।

ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক