ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনের প্রায় দুই বছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত কোনো এক পক্ষের সামরিক বিজয়ের কোনো আলামতই দেখা যাচ্ছে না।
কোনো মীমাংসা ও যুদ্ধবিরতির লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। কিয়েভ কিংবা মস্কো—দুই পক্ষের কেউই তাদের যুদ্ধলক্ষ্যের সঙ্গে আপস করতে চায় না। আবার সেই লক্ষ্যে কীভাবে তারা পৌঁছাবে, তারও পরিষ্কার কোনো পথ তাদের সামনে খোলা নেই।
২০২২ সালের শেষ দিকে যুদ্ধের ভরকেন্দ্র ইউক্রেনের দিকে হেলে গিয়েছিল। ইউক্রেনীয় বাহিনী সফল পাল্টা আক্রমণে উত্তরাঞ্চলের খারকিভে বিশাল আয়তনের ভূমি পুনরুদ্ধার করেছিল। এ আক্রমণে দক্ষিণাঞ্চলের খেরসন থেকে রাশিয়া তাদের সেনাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই রাশিয়া প্রতীকী তাৎপর্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সোলেদার (২০২৩ সালের জানুয়ারি) ও বাখমুত (২০২৩ সালের মে মাসে) দখলে নেয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, বিশেষ করে জনবল ক্ষয়ের বিনিময়ে রাশিয়া এই দুটি জয় অর্জন করে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ক্রেমলিন তার সংকল্প ও সক্ষমতার প্রদর্শন করে।
এরপরেই জুনে ইউক্রেনের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক সেই অভিযান মাঠে গড়াতে অনেক সময় গড়িয়ে যায়। ইউক্রেনের এবারের পাল্টা আক্রমণে আগের বছরের মতো সাফল্য পাওয়া যায়নি। ফলে বছর শেষে রাশিয়ার কাছ থেকে খুব সামান্য ভূমি নিজেদের অধিকারে নিতে পেরেছে ইউক্রেন।
সার্বিক যুদ্ধের বিবেচনায় স্থলের চেয়ে বরং সমুদ্রে ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশি সফলতা পেয়েছে। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার নৌশক্তিকে খর্ব করে দিতে পেরেছে তারা। ফলে রাশিয়া তাদের নৌঘাঁটি ক্রিমিয়া থেকে তাদের মূল ভূখণ্ডে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে সবচেয়ে তীব্র লড়াইটা চলছে দনবাস অঞ্চলে। এ লড়াইয়ে কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়া জনবলে শ্রেষ্ঠ। এ ছাড়া ইউক্রেনের অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুতেও টান পড়েছে। ফলে যুদ্ধে এখন রাশিয়া সুবিধা করতে পারছে। ২০২৪ সালেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
রাশিয়ার আক্রমণ ও ভূমি দখল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাই এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে। এ ধরনের রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে পারলে ইউক্রেন নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য নতুন কৌশল প্রণয়নের সময় পাবে।
এই বাস্তবতা ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে পাল্টা আক্রমণে যেতে সমস্যায় ফেলবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার দিক থেকে নতুন আক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করবে। এখন ক্রেমলিনের দিক থেকেও তাদের আক্রমণ অভিযানে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। শিগগিরই বড় কোনো সফলতা আসবে, সে রকম কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। যাহোক, এই স্থিতিবস্থাকে ব্যবহার করে রাশিয়া এখন তাদের যুদ্ধ অর্থনীতি স্ফীত করতে পারে। উত্তর কোরিয়ার মতো মিত্রের কাছ থেকে আরও অস্ত্র আমদানিও করতে পারে।
১৪ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বার্ষিক ভাষণে বলেছেন, ইউক্রেনকে ‘নাৎসিমুক্ত, নিরস্ত্রীকরণ ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ করার অভীষ্ট অর্জন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পক্ষে এ ধরনের কিছু মেনে নেওয়া কঠিন। এটি তিনি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন। জেলেনস্কি বলেছেন, ন্যায়সংগত ও টেকসই শান্তির জন্য তাঁর দেওয়া ১০ দফার ফর্মুলাই একমাত্র সমাধান। তবে জেলেনস্কি স্বীকার করেন, সংঘাত কবে শেষ হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা তার জানা নেই।
জেলেনস্কির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা ও মুখ্য সচিব আন্ড্রি ইয়েরমাক জনসমক্ষে কথা বলার সময় ইউক্রেনীয়দের বিজয়ের ব্যাপারে বেশ উচ্চকিত। সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৭৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে শান্তির বিনিময়ে এক ইঞ্চি ভূমি ছাড় দিতে রাজি নন।
নতুন বছরে যখন আরও সংঘাতময় যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, সে সময়ে পশ্চিমাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন নড়বড়ে হওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছেই।
এ যুদ্ধে ইউক্রেনের লক্ষ্য হলো, রাশিয়া তাদের কাছ থেকে যতটা পরিমাণ ভূমি দখলে নিয়েছে, তার সবটা নিজেদের আয়ত্তে নেওয়া। ইউক্রেনীয়দের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি কথার তুবড়ি ছুটিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন দিলেও যুদ্ধক্ষেত্রে জেতার জন্য যে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দেওয়া দরকার, তা দিতে তারা দ্বিধান্বিত।
এ ঘটনা রাশিয়ার দখলকৃত ভূমি মুক্ত করার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রচেষ্টাকেই ব্যর্থ করছে না, রাশিয়াকে কোনো অর্থপূর্ণ মীমাংসায় বসানোর বাস্তবতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে যুদ্ধে আগামী বছর পুতিনকে হারানো যাবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না।
কিন্তু আরও একটি বছর যদি এ রকম অচলাবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ইউক্রেনের জন্য সেটা হবে একটা সুযোগ।
রাশিয়ার আক্রমণ ও ভূমি দখল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাই এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে। এ ধরনের রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে পারলে ইউক্রেন নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য নতুন কৌশল প্রণয়নের সময় পাবে।
এ ধরনের কৌশল নিলে ইউক্রেন তাদের পরিকল্পনামাফিক পাঁচ লাখ নতুন সেনা নিয়োগ করা এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে। এর মাধ্যমে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও বিধ্বস্ত ইউক্রেনীয় বাহিনীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা সম্ভব হবে।
ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা এতে তাদের হাতে সময় পাবে। ইউক্রেনকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কী করা যাবে, তা তারা ভাবনাচিন্তা করতে পারবে। এই অর্থ ইউক্রেনের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রসদ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থ ছাড় করলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ওপরও চাপ তৈরি হবে।
একই সঙ্গে ইউক্রেন এখন নিজেদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উন্নয়ন ও উৎপাদনের চেষ্টা করছে, সে কাজও এগিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা অস্ত্র কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করার চিন্তা করা হবে প্রথম পদক্ষেপ।
এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে ২০২৪ সালে নতুন আগ্রাসনে যেতে রাশিয়াকে বিরত রাখবে, যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ নতুন করে কষতেও মস্কোকে বাধ্য করবে।
বেশির ভাগ যুদ্ধের মতো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনও আলাপ-আলোচনার টেবিলে অবসান হবে। ২০২৪ সালে সেটা যদি না–ও সম্ভব হয়, তার মানে এই নয় যে মীমাংসার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা থেমে থাকবে।
স্টিফেন উলফ, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত