যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া—বাংলাদেশে কার জোর বেশি? বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি নির্বাচন নিয়ে এদের প্রায় সবারই সরব ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, দেশের গতিপথ নির্ধারণে কাদের প্রভাব বেশি কার্যকর হবে? কাদের হাতে যাবে দেশ? বর্তমান সরকারের আমলে এই দেশে এদের সবারই ব্যবসা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে, সামনে আরও বহু প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। সবাই খুশি এবং আরও পেতে মরিয়া। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত আধিপত্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বাড়ছে।
চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত জোর চীনের বেশি থাকলেও রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ছাড়াও প্রভাবক্ষেত্র বহুবিধ—রাজনৈতিক, শিক্ষা-গবেষণা, মিডিয়া, সামরিক। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ তার শক্তিশালী সহযোগী, বাংলাদেশে যারা প্রধান নীতিনির্ধারক। এডিবিতে বড় ভূমিকা জাপানের, সেটিও এদেরই আরেকটি মুখ। একই পথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র শতহস্ত উদ্যোগী।
বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর অধিকাংশেরই মূল ভূমি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে জ্বালানিক্ষেত্রে শেভরন এবং কৃষিক্ষেত্রে মনসান্টো শীর্ষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ আবিষ্কৃত বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা এখন শেভরনের হাতে। ১৯৯৩ সালে এই গ্যাসব্লক পেয়েছিল মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল। ১৯৯৭ সালে এই কোম্পানির কারণেই মাগুরছড়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। তাতে বাংলাদেশ চিরতরে হারায় বড় গ্যাসের মজুত, যা দিয়ে বর্তমানে পুরো দেশের এক বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী এর মূল্য প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার; এ ছাড়া পরিবেশের ওপর স্থায়ী ক্ষতি তো আছেই। কিন্তু এসব ক্ষতিপূরণ না দিয়ে পর্দার পেছনে নানা সমঝোতার মাধ্যমে অক্সিডেন্টাল তার ব্যবসা আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনোক্যালের কাছে বিক্রি করে চলে যায়। ইউনোক্যাল গ্যাস রপ্তানির চেষ্টায় দেশ গরম করে, প্রতিরোধের কারণে তাতে ব্যর্থ হয়ে শেভরনের কাছে ব্যবসা বিক্রি করে তারাও ক্ষতিপূরণ না দিয়ে অবাধে চলে যায়।
মুখের কথার বিপরীতে সরকার দেখে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ, দেশের ভেতর দেখে ব্যাংকের মালিক, গার্মেন্টসের মালিক, বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী, দালান ব্যবসায়ীদের জোট আর কমিশনভোগীদের স্বার্থ। কীভাবে দেশ সর্বজনের হাতে আসবে, সে প্রশ্ন জোরদার করতে গেলে এসব গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। না হলে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার—সবই কথার কথা থাকবে।
বঙ্গোপসাগরে সীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে নিষ্পত্তি হওয়ার পরও সরকার গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ কারণে গ্যাস–সংকট তৈরি হয়েছে এবং তার অজুহাতে একদিকে একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে, অন্যদিকে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির পথ ধরা হয়েছে। এ প্রতারণা দেশি–বিদেশি বেশ কিছু গোষ্ঠীকে বড় ব্যবসা দিয়েছে, কিন্তু তা আমাদের জন্য এনেছে প্রাণ–প্রকৃতি বিনাশ এবং বিদ্যুতের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি।
সর্বশেষ বঙ্গোপসাগরের ১৫টি ব্লকের সব কটি নিয়েই আগ্রহ দেখাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল, সাগরের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এদের জন্য উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির মডেল সংশোধন করে গ্যাসের দাম, মুনাফার ভাগ অনেক বাড়ানো হয়েছে, রপ্তানির সুযোগ তো আছেই। যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নানা কথা বলছে, তখন বিনা দরপত্রে বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাসের ব্লক পেতে তাদের কোম্পানির দেনদরবার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতের বড় বিনিয়োগ, যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ১০ বছর ধরে হামলা–হুমকি সত্ত্বেও যুক্তি–তথ্য দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তারপরও এ প্রকল্প নিয়ে ভারত লেগে থাকায় প্রমাণিত হয়, তার জন্য এ প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার বিশাল ঋণের টাকায় নির্মিত হচ্ছে মহাবিপদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও ভারতের। সেটাও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ভারতের মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে বড় বড় ব্যবসা দেওয়া বাড়ছে। কয়েক দিন আগে আদানি সাহেব নিজ উড়োজাহাজে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গেছেন। এদিকে রাশিয়ার রোসাটমের পারমাণবিক প্রকল্প ছাড়াও গাজপ্রমকে একের পর এক অযৌক্তিক প্রকল্প দেওয়া হচ্ছে বাপেক্সকে কোণঠাসা করে, যার জন্য ব্যয় বাড়ছে গ্যাস উত্তোলনের।
বাণিজ্য ছাড়াও বেশ কয়েকটা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং সেতু-সড়কসহ অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের বড় অংশগ্রহণ তৈরি হয়েছে। কয়লাবিদ্যুতের মধ্যে পায়রা ও বাঁশখালী অন্যতম। বাঁশখালী প্রকল্পে কয়েক পর্যায়ে পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর গুলিতে এ পর্যন্ত ১২ জন শ্রমিক খুন হয়েছেন। এলাকার মানুষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে জমি দখল ও এই প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ করেছিলেন। চীন পিছু হটেনি; বরং জবরদস্তি, গুলি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফুলবাড়ীর দিকেও এখন চীনের নজর।
বাংলাদেশে চীন ও ভারত এখন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করলেও তারা নিজেরা কয়লা থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। জার্মানিসহ ইউরোপ নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাত্রা জোরদার করেছে, কিন্তু তাদেরই বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন দেশে কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবসা করছে। জার্মানির একটি কোম্পানি ফিখনার রামপাল প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। জার্মানির আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে একবার আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল বনে। বলেছিলাম, ‘তোমরা দেশে কয়লা পারমাণবিকের মতো বিষাক্ত জ্বালানি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছ অথচ তোমাদের কোম্পানি সুন্দরবনের মতো মহাপ্রাণবিনাশী প্রকল্পে শরিক হচ্ছে। সেটা কেন তোমরা অনুমোদন করছ?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমরা প্রাইভেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিছু করতে পারি না।’ আমি বললাম, ‘তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে তোমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? অন্য দেশে গিয়ে তোমাদের কোনো নাগরিক অন্যায় করলে কি তোমারা কোনো উদ্যোগ নেবে না?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই। কেউ যদি সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হয়, অর্থ পাচার করে, তাহলে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ আমি বললাম, ‘যেসব কোম্পানি প্রাণ–প্রকৃতি ও মানুষবিনাশী তৎপরতায় যুক্ত হয়, তারা কি ওই অপরাধীদের চেয়ে কম ক্ষতি করে? তারা তো আরও বড় সন্ত্রাসী!’ তাঁর কোনো জবাব ছিল না।
যাহোক, বাংলাদেশ সরকারের কর্তারা দাবি করেন, তাঁরা বিদেশিদের কথা শোনেন না, তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। ভুল। কারণ, জনগণের প্রতিনিধি হতে গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হয়, যার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তাঁরা নষ্ট করেছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন ঠিক, কিন্তু সেটা ২০০৮ সালে, তার মেয়াদ বহু আগেই শেষ। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যে জনগণের চেয়ে বিদেশিদের কথা বা স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেন, তার বহু প্রমাণ আছে। এর দুটি শুধু বলি। একটি হলো রামপাল প্রকল্প, বাংলাদেশের সব পর্যায়ের মানুষ এর বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু সরকার তা না শুনে ভারতের দাবি অনুযায়ী সর্বনাশা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। দ্বিতীয়ত, ক্রসফায়ার–এনকাউন্টার নামের রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে আইনি প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার দাবি বহুদিন ধরে দেশের মানুষ জানিয়েছেন, কাজ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর এটি অনেকখানি বন্ধ হয়েছে। তাহলে কাদের কথা শোনে সরকার?
মুখের কথার বিপরীতে সরকার দেখে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ, দেশের ভেতর দেখে ব্যাংকের মালিক, গার্মেন্টসের মালিক, বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী, দালান ব্যবসায়ীদের জোট আর কমিশনভোগীদের স্বার্থ। কীভাবে দেশ সর্বজনের হাতে আসবে, সে প্রশ্ন জোরদার করতে গেলে এসব গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। না হলে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার—সবই কথার কথা থাকবে।
• আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক
sarbojonkotha@gmail.com