ভয় ধরানো বিশ্বমন্দা কি আসলেই ধেয়ে আসছে

‘মন্দা’ এমন একটি ভীতিকর শব্দ এবং এই শব্দের মধ্যে এমন একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার দ্যোতনা নিহিত থাকে
অলঙ্করণ: আরাফাত করিম

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং বাণিজ্যিক অস্থিরতা নিয়ে এত কথা হয়েছে যে সর্বত্র ছাপিয়ে যেতে থাকা বিদ্যমান হতাশা যুক্তিসংগত ও ন্যায়সংগত কি না, তা নিয়ে অনেকেই ধন্দে পড়ে গেছেন। তবে চারটি কারণে আমি হতাশাবাদে ডুবতে রাজি নই।

প্রথমত, মন্দা সম্পর্কে জনমনে গেড়ে বসা ধারণা যে কতটা ব্যাপক হয়ে উঠেছে, তা দেখে আমি হতবাক। প্রায় প্রত্যেকেই এখন বিশ্বাস করে, উন্নত দেশগুলো মন্দার দিকে যাচ্ছে অথবা ইতিমধ্যে মন্দাবস্থায় পড়ে গেছে।

বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে ব্যবসাসংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকেন এমন লোকদের আমি একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছি, যেখানে তাঁদের সবাই জানতে চেয়েছেন, ‘মন্দা মোকাবিলায় কীভাবে প্রস্তুত হতে হয়?’ আমি তাঁদের একজনকে বলেছিলাম, আমি এমন কোনো মন্দার কথা জানি না, যার বিষয়ে আগেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল এবং ঠিক সে অনুযায়ী মন্দা আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে।

এর প্রধান কারণ, ‘মন্দা’ এমন একটি ভীতিকর শব্দ এবং এই শব্দের মধ্যে এমন একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার দ্যোতনা নিহিত থাকে যে তা সাধারণত কেউ প্রত্যাশা করে না। অর্থনৈতিক পূর্বাভাসদাতারাও মন্দা একেবারে দুয়ারে চলে না আসা পর্যন্ত সেটিকে দেখতে পান না। এমনটা ঘটেছিল ২০০৭-০৮ সালে (যা স্বীকৃতভাবে ছিল অনন্য) এবং আবার কোভিড-১৯ আসার পর ২০২০ সালে।
তা সত্ত্বেও এখন অনেকে, এমনকি কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন ব্যাংক অব ইংল্যান্ড) রাখঢাক না করেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ বছরের শেষের দিকে বড় ধরনের বৈশ্বিক মন্দা হবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে। তার মানে কি অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের মান হঠাৎ আগের চেয়ে উন্নত হয়ে গেছে, নাকি অন্য কিছু চলছে?

এটি সত্য যে পরপর দুটি ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধি নেতিবাচক হলে সাধারণত সেটিকে একটি ঋণাত্মক অর্থনৈতিক লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং মনে করা হয়, অর্থনীতি মন্দার মধ্যে রয়েছে। এটিও সত্য যে মার্কিন জিডিপি এই বছরের প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকে হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু এটি দেখেই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে না এসে অবশ্যই আপাতসংকোচনের সুনির্দিষ্ট কারণগুলোকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের মধ্যে পণ্য মজুত হ্রাসের মতো কিছু বিষয় বৃহত্তর অর্থনীতি সম্পর্কে যে গল্প বলে, তা অন্যান্য সূচকের উল্টো চিত্র দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের জুলাই মাসের কর্মসংস্থান রিপোর্ট প্রত্যাশার চেয়েও উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী ছিল। সেই তথ্যের আলোকে যদি ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ যুক্তরাষ্ট্রকে মন্দায় না থাকার ঘোষণা দেয়, তাহলে আমি মোটেও অবাক হব না।

কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন ব্যাংক অব ইংল্যান্ড) রাখঢাক না করেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ বছরের শেষের দিকে বড় ধরনের বৈশ্বিক মন্দা হবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে। তার মানে কি অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের মান হঠাৎ আগের চেয়ে উন্নত হয়ে গেছে, নাকি অন্য কিছু চলছে?

মন্দা সম্পর্কে প্রচলিত ভাষ্য সম্পর্কে আমার সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ হলো, সব মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি সূচক টেকসই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দিক নির্দেশ করে না। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের পাঁচ বছরের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত প্রত্যাশা সূচকটি অল্প সময়ের জন্য ৩ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর এটি আবার ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে বোঝা যায়, গড় ভোক্তারা এই বছরের মুদ্রাস্ফীতির বিশাল উত্থানকে দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নয় বরং অস্থায়ী বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছেন।

আর হ্যাঁ, আপনি যদি ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডে থেকে থাকেন, তাহলে এই অনুসন্ধানে খুব বেশি আস্থা আনাটা অনেক আগাম ব্যাপার হয়ে যাবে। ভোক্তাদের মনোভাব যদি আগামী মাসগুলোতে সহজ হতে থাকে, তবে আমি ধারণা করি, ফেডারেল রিজার্ভ আগের চেয়ে কম মারমুখী হবে।

তৃতীয়ত, যদিও অনেক পণ্যের দাম এক বছর আগের এই সময়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, তথাপি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেই মূল্যবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়েছে। এই মূল্য তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলে অনেক দেশে মোটা দাগের মুদ্রাস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করবে।

মজার বিষয় হলো, ব্যুরো অব ইকোনমিকসের মন্দার পূর্বাভাস এবং এমনকি উচ্চ মূল্যস্ফীতি যখন যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছে, তখন খুব কম লোকই লক্ষ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৩ সালের বেশির ভাগ সময়জুড়ে মূল্যস্ফীতি উচ্চ শিখর থেকে দ্রুত পড়ে যাবে বলে আশা করছে।

পরিশেষে আজকাল বেশির ভাগ বিনিয়োগ-ব্যাংকের গবেষণা বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেকোনো আর্থিক বাজার সমাবেশের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে লড়াই করবে, কারণ তারা উচ্চ বেকারত্ব, ঊর্ধ্বমুখী মজুরির চাপ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এসবের জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। স্মরণ করুন, ২০২০ এবং ২০২১ সালজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে মতৈক্য ছিল বলে মুদ্রাস্ফীতি ক্ষণস্থায়ী ছিল। যদিও পরে তারা তাদের সুর কিছুটা বদলেছে, তবে দেখা যাচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ ভুল পথে ছিল না।

তবে এটিও মাথায় রাখতে হবে, এখনই অতি আশাবাদী হওয়াটা অতি আগাম হয়ে যাবে। আমি এমন ধারণা দিতে চাই না যে মন্দার আশঙ্কাটা অযৌক্তিক। যদি সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি সংকেত (যেমন নিত্যপণ্য, আবাসন এবং ব্যবহৃত গাড়ির দাম) এবং দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যাশার বিপরীত হয়, আমাকে আমার অবস্থান থেকে পিছুটান দিতে হবে। কিন্তু ৪০ বছরের ভালো আর্থিক বাজারে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার পর আমি সব সময় এ বিষয়ে আশাবাদী যে যখন কোনো আর্থিক সংকটের বিষয়ে শক্তিশালী মতৈক্য হয়, তখন তা উতরে ওঠা কঠিন হয় না।
যা-ই হোক না কেন, আমি অবশ্যই আশা করি, হতাশাবাদ অতিমাত্রায় পৌঁছানোর আগেই তা কমতে শুরু করবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং গোল্ডম্যান স্যাক্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমানে প্যান ইউরোপিয়ান কমিশন অন হেলথ অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের একজন সদস্য।