পাকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ২১ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ডাকতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি অধিবেশন ডাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়ায়।
এ অবস্থায় জাতীয় পরিষদের স্পিকার তথা সংসদ সচিবালয় কর্তৃক ২৯ ফেব্রুয়ারি নতুন অধিবেশন আহ্বানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের অধিবেশন আহ্বান করে দুই নতুন প্রাদেশিক সরকারও গঠন করা হয়েছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) মরিয়ম নওয়াজ, আর সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন পিপিপির মুরাদ আলী শাহ।
কেন্দ্রেও এ দুই দল ক্ষমতা ভাগাভাগি করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। প্রেসিডেন্ট হবেন পিপিপি থেকে আসিফ আলী জারদারি এবং প্রধানমন্ত্রী হবেন পিএমএল-এন থেকে শাহবাজ শরিফ। ক্ষমতাসীন জোটে আরও চারটি দল থাকছে।
২ মার্চের মধ্যেই এ সরকার গঠিত হতে পারে। জাতীয় পরিষদে ছয়দলীয় জোটের ২০৭ সদস্য হয়ে যাবে। এতে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। ৩৩৬ সদস্যের পার্লামেন্টে সরকার গঠনের জন্য ১৬৯ আসন প্রয়োজন।
পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিংবা জাতীয় পরিষদের বিরোধ নতুন নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সামরিক শাসক দ্বারাই বরখাস্ত হয়েছেন। তবে পঞ্চাশের দশকে অবিভক্ত পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট দ্বারা প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হওয়ার একাধিক উদাহরণ আছে।
নব্বইয়ের দশকে বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ একাধিকবার বরখাস্তের শিকার হয়েছেন, যার পেছনে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ হাত ছিল।
কিন্তু এবারে সেনাবাহিনী আর রাখঢাক করেনি। তারা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে; যদিও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছেন।
২০২২ সালে ইমরান খানের সরকারকে অনাস্থা ভোটে হারিয়ে দেওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে সেনাবাহিনী। তারা পিটিআই জোট থেকে শরিক দলগুলোকে ভাগিয়ে নেয়। এরপর মুসলিম লিগ-পিপিপি জোট সরকার গঠন করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যাতে ইমরান খান অংশ নিতে না পরেন, সে জন্য কয়েকটি মামলায় দ্রুত তাঁকে সাজা দেওয়া হয়, যার একটি ছিল বুশরা বেগমের সঙ্গে বিয়েসংক্রান্ত।
এই মামলার রায়ের পর পাকিস্তানের এক সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘আদালত ব্যক্তির শয়নকক্ষেও ঢুকে পড়েছেন।’ এ ছাড়া তোশাখানা মামলা ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করা মামলায়ও ইমরানকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ইমরানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্যই এটি করা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন দলের প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও কেড়ে নিয়েছে। ফলে পিটিআইয়ের অনুসারীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো প্রতীক দেখে ভোটাররা ভোট দেন। সেই প্রতীক কেড়ে নিয়ে নির্বাচন কমিশন পিটিআইকে নির্বাচনী মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানে ভোটবিপ্লব হয়েছে। পিটিআইয়ের অনুসারী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই এককভাবে বেশি আসন পেয়েছেন। ইমরান খানের দাবি, তাঁদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিপুল বিজয় পিটিআইয়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পিএমএল-এন ও পিপিপিকে বেকায়দায় ফেলে। এ অবস্থায় তাদের উদ্ধার করতে আসে সেনা নেতৃত্ব।
নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পাকিস্তানের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সরকার গঠন করা। পিটিআই যেহেতু দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারেনি, তাঁর দৃষ্টিতে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশ নয়।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার বিষয়ে পিএমএল-এন, পিপিপি প্রভৃতি দল ২১ দিনের বাধ্যবাধকতার দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন মানে সংরক্ষিত ৭০ আসন বাদ দিয়ে নয়। ৭০ আসনের নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে বলেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেবল পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সংবিধানবিরোধীও।
সংবিধানে আছে, সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু তারা পিটিআই সংরক্ষিত কতটি আসন পাবে, সে বিষয় ঝুলিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য, যেকোনো মূল্যে পিটিআইকে ক্ষমতার বাইরে রাখা।
রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে নানা কৌশল নিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি কাউকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তখন আর রাজনৈতিক দলের কিছু করার থাকে না। তবে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও যে ভোটবিপ্লব হতে পারল, সেটা বেসামরিক প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের এই দ্বৈরথ কীভাবে নিষ্পত্তি হয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে আলভির স্থলে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিংবা নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের মাধ্যমেই পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট শেষ হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার বলেছেন, তিনি সেখানকার ১২টি আসনে অন্যায়ভাবে পিটিআইয়ের জয়ী প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। এ অপরাধের দায় স্বীকার করে তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। করাচি প্রাদেশিক পরিষদের জামায়াতে ইসলামির এক প্রার্থী বলেছেন, তিনি নির্বাচনে জয়ী না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ রকম উদাহরণ বাংলাদেশে কোনো দলীয় নেতা দেখাতে পেরেছেন, এ রকম নজির নেই।
প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ছিলেন ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা। ২০১৮ সালের আগস্টে ইমরান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরের মাসে পিটিআই–মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আরিফ আলভি। মেয়াদ শেষ হলেও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।
জাতীয় পরিষদ সচিবালয় বলছে, নির্বাচন হওয়ার পর ২১তম দিনে অধিবেশন ডাকার জন্য প্রেসিডেন্ট বা স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। প্রেসিডেন্ট মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত আসনগুলো বণ্টন না হওয়ায় জাতীয় পরিষদ অসম্পূর্ণ রয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনে জয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংখ্যানুপাতিক হারে জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত ৭০টি আসন বণ্টন করে দেওয়ার কথা পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের। এ আসন পেতে পিটিআই-সমর্থিত জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইতিমধ্যে সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিলে (এসআইসি) যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এসআইসি সংরক্ষিত আসন পাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ইমরান খানের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিলেও তাঁদের সংরক্ষিত আসন দেওয়া হয়নি। তা ঝুলিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
গতকাল সোমবার সচিবালয় থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৯১ ধারার অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ২১ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী ২১তম দিনে অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন প্রেসিডেন্ট আলভি। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ অবস্থায় জাতীয় পরিষদের সচিবালয় বলেছে, নির্বাচনের ২১তম দিনে অধিবেশন আহ্বান করা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারের নোটিফিকেশন অত্যাবশ্যক নয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন জিও নিউজ।
প্রেসিডেন্ট আলভি মনে করেন, এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত আসনগুলো বণ্টন করা হয়নি। এর ফলে পার্লামেন্ট অসম্পূর্ণ। এ জন্য অধিবেশন আহ্বান করা যাবে না।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত আসন বণ্টন করেছে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এসআইসির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর তাঁদের সংরক্ষিত আসন দেয়নি নির্বাচন কমিশন। উল্টো তারা বলেছে, এসআইসির সংরক্ষিত আসন কমিশনের কাছে মুলতবি অবস্থায় আছে।
এদিকে পিটিআইয়ের প্রধান গহর খান বলেছেন, সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের কোনো অধিবেশন বসতে পারে না। এমনকি পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনও ডাকা হয়েছে অবৈধভাবে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনও সংরক্ষিত আসন বণ্টনের আগে আহ্বান করা হলে সেটিও অবৈধ হবে। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে অবিলম্বে এসআইসির সংরক্ষিত আসন নির্ধারণের আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের এই দ্বৈরথ কীভাবে নিষ্পত্তি হয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে আলভির স্থলে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিংবা নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের মাধ্যমেই পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট শেষ হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি