বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষা: কার কতটা দরকার

প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২.১ শতাংশ ব্যয় করে, বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যা ১৮৪তম। একে তো জাতীয় ব্যয় স্বল্প, তার মধ্যে বিষয় খাতে যদি দেখি, তবে জানতে পাই, আমরা ইংরেজি শিক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয় করি এবং বাংলা ও স্টেম বিষয়ে কম ব্যয় করি।

আমরা জানি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের শিক্ষা খাতে ব্যয় নিয়ে খুব কমই গুরুতর আলোচনা হয়েছে। সহজ কথায়, ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ বলতে আমরা বোঝাতে চাইছি, ইংরেজি শিক্ষার অর্থনৈতিক খরচ কী এবং ইংরেজি শিক্ষা থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা কী এবং আয়-ব্যয়ের তুলনা।

আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষার খরচ বা ইংরেজি শিক্ষার সুবিধাগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। বস্তুত, অর্থনৈতিক গুণক ছাড়া অন্যান্য গুণক বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রভাবিত করেছে। প্রথমেই হলো, উপনিবেশবাদীদের দ্বারা ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সমাজে উচ্চ মর্যাদা সংশ্লিষ্ট করা। তারপর স্বাধীনতা-উত্তর কালে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশিদের আকর্ষণ গিয়েছে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার প্রতি। বাংলাদেশের মধ্যে একটি ছোট, কিন্তু শক্তিশালী অভিজাত ও ছদ্ম-অভিজাত গোষ্ঠীর প্রভাব ইংরেজি প্রচার করছে।

এসব কারণে ইংরেজি শিক্ষার সুবিধাগুলো কৃত্রিমভাবে অতিরঞ্জিত হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের একটি নীতি ও সেই নীতি কার্যকর করা—নীতিটি সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধ আলোচনা হয়নি বা যাচাই করা হয়নি। নীতিটি হলো, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা। বিশ্ব অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিশ্বায়নও একটি শক্তিশালী ধারণা তৈরি করেছে জাতির মধ্যে যে ইংরেজি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইতিবাচকভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এটি এখনো পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত নয়।

ইংরেজি শিক্ষার প্রকৃত চাহিদা বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত ও উপখাতের নয়, বরং নির্দিষ্ট খাত ও উপখাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই অর্থে, সেগমেন্টেড মার্কেট বা বিভাজিত বাজারে ইংরেজি শিক্ষার জন্য খরচ এবং সুবিধাগুলো অনুমান করা যেতে পারে। সমগ্র অর্থনীতির তুলনায় খণ্ডিত বাজারে ইংরেজি শিক্ষার খরচ এবং সুবিধা অনুমান করা সহজ।

তদুপরি, বাংলাদেশে একটি অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনা ইংরেজি শিক্ষার খরচ ও সুবিধার ভুল অনুমানে অবদান রাখে। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটি আমাদের দেশের ইতিহাসের এক আবেগঘন মুহূর্তে গৃহীত হয়েছিল। এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল, জাতির নিজস্ব অধিকারে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ হবে। কিন্তু, দুটি বিষয় এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। প্রথমত, সেই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরাজমান অস্থির পরিস্থিতি; যে কারণে শিক্ষার মানের সম্পূর্ণ অভাব দেখা গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য সম্পর্কিত বই বাংলায় অনুবাদ বা রচনা করার জন্য সরকারের কর্মসূচি অনুপস্থিতি ছিল।

শিক্ষা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছে। তত দিনে স্কুলব্যবস্থা মধ্যমানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। শিক্ষার মানের মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি, বাংলাদেশে ইংরেজির দুঃখজনক গুণমান সমাজের আধিপত্যশীল শ্রেণির জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজার পরিবর্তে বাংলা চালু করার সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে দোষারোপ করতে থাকে।

বুদ্ধিজীবীদের ভুল দিকনির্দেশনা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বিস্তারের দিকে পরিচালিত করে, যে কারণে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, ইংরেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বিদেশি প্রভাব এবং নির্দিষ্ট শিক্ষাগত মডেলের প্রসার ঘটে। আরও দুঃখের বিষয় হলো, সরকার নিজেই বাংলা পাঠ্যক্রমের তথাকথিত ইংরেজি সংস্করণ চালু করে ব্যান্ডওয়াগনে (কাফেলায়) যোগ দিয়েছে। মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের ধারণা, এর ফলে ইংরেজি শিক্ষা পেলে তাদের সন্তানেরা সুবিধা ভোগ করতে পারবে। সে জন্য সুবিধা যেখানেই পাওয়া যায়, সেখানেই ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ছুটছেন।

সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, ইংরেজি শিক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে অন্যান্য বিষয়ে, বিশেষ করে বাংলা ও স্টেম বিষয়ে কম খরচ করা হচ্ছে। একই সময়ে ইংরেজি শিক্ষা ছাত্রদের একটি বৃহৎ অংশের জন্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে অসম পরিমাণ সময় নষ্ট করার কারণ হয়েছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, সব ছাত্রছাত্রীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বা তাদের কর্মজীবনে ইংরেজিতে উচ্চ স্তরের দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা তাদের দক্ষতার অভিপ্রেত স্তরে পৌঁছানোর প্রাথমিক চালিকা শক্তি হওয়া উচিত। শিক্ষাব্যবস্থা ভাষাশিক্ষার সব বিভাগে—শব্দভান্ডার, বানান, উচ্চারণ, শ্রবণ, কথা বলা, পড়া ও লেখায়—সব শিক্ষার্থী ন্যূনতম বা মৌলিক স্তরের দক্ষতা লাভ করবে তার ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে, পাঠ্যক্রমের বাইরে সুযোগ তৈরি করে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের উচ্চ স্তরের দক্ষতা অর্জনের সুযোগও দেবে।

একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর সঙ্গে আমাদের কাজের অংশ হিসেবে গ্রামীণ বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে আমরা দুজনই জড়িত ছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতা এবং বিশ্লেষণ আমাদের বাংলাদেশের, বিশেষ করে গ্রামীণ বাংলাদেশের, সাধারণ মানুষের ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে কিছু অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার প্রকৃত চাহিদা বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত ও উপখাতের নয়, বরং নির্দিষ্ট খাত ও উপখাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই অর্থে, সেগমেন্টেড মার্কেট বা বিভাজিত বাজারে ইংরেজি শিক্ষার জন্য খরচ এবং সুবিধাগুলো অনুমান করা যেতে পারে। সমগ্র অর্থনীতির তুলনায় খণ্ডিত বাজারে ইংরেজি শিক্ষার খরচ এবং সুবিধা অনুমান করা সহজ।

আমরা বাংলাদেশে ইংরেজির জন্য বিভিন্ন বিভাজিত বাজার এবং শিক্ষা খাতের উপখাতে প্রয়োজনীয় ইংরেজির ‘স্তর’ চিহ্নিত করেছি।

১. ‘উচ্চ’ স্তরের ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন:
(ক) ইংরেজি শেখানো (মাধ্যমিক এবং তৃতীয় স্তর)
(খ) বিচার বিভাগের উচ্চ স্তরে কাজ করা; বিদেশে সরকারি কাজ করা; আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কার্যভার নেওয়া; বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির অফিসে কাজ করা
(গ) মিডিয়ার জন্য কাজ করা (ইংরেজি)
(ঘ) বিদেশে কর্মসংস্থান বা পড়াশোনার জন্য লোকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া

২. ‘মাঝারি’ স্তরের ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন:
(ঙ) প্রশাসনে কাজ করা; প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করা
(চ) বিদেশে দক্ষ ও অর্ধ-দক্ষ চাকরিতে কাজ করা

৩. ইংরেজিতে ‘বিশেষ’ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন:
(ছ) একজন বিশেষজ্ঞ পেশাদার হওয়া (চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ইত্যাদিতে)
(জ) আইসিটি খাতে কাজ করা
(ঝ) শিল্পের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল-সম্পর্কিত এলাকায় কাজ করা; পর্যটন এবং আতিথেয়তা শিল্পে কাজ করা

আমাদের দৃষ্টিতে, ইংরেজি শিক্ষার অর্থনৈতিক আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ ইংরেজি, বাংলা ও স্টেম বিষয়ের শিক্ষায় সঠিক পরিমাণে ব্যয়ের দিকে পরিচালিত করবে আমাদের। এই লক্ষ্যে আমরা সুপারিশ করছি:

১. সরকার যেন মাঝারি এবং উচ্চ স্তরের দক্ষতা নিয়মিত পাঠ্যক্রমের বাইরে রেখে, জনগণের সাধারণ মৌলিক চাহিদা মেটাতে ইংরেজি পাঠ্যক্রমের একটি কার্যকর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে।

২. সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো অর্থনীতির বিভিন্ন বিভাগে খরচ এবং সুবিধাগুলোর উপাত্ত এবং তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করতে একসঙ্গে কাজ করে, যেসব বিভাগের জন্য মৌলিক স্তরের বাইরে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন হয়।

  • মতিলাল পাল আন্তর্জাতিক এনজিও ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের (ভিএবি) সাবেক কর্মকর্তা

  • জসিমুজ জামান আন্তর্জাতিক এনজিও ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের (ভিএবি) সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর